মধ্যরাতের কান্না

সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা

রাত বারোটা এক। মুহর্মুহু বাজি পোড়ানোর বিকট শব্দ। চারপাশ প্রকম্পিত হচ্ছিল। হৃদি হকচকিয়ে বিছানা ছেড়ে এগিয়ে যায় জানালার পাশে। জানালার কপাট খুলে দৃষ্টি ফেলে দিগন্তের বাইরে। নিচে আলীমুদ্দিনের বস্তিঘর। তার উত্তরে একটি খালি জায়গা। সেখানে উঠতি বয়সী তরুণদের জটলা। সম্ভবত এরা বস্তির ছেলে। বিজয় দিবস সামনে রেখে বাজি পোড়ানোর মহোৎসব করছে। হৃদি খানিক দাঁড়িয়ে আবারও ফিরে আসে বিছানায়। আচমকা মিনতি দেবীর ঘুম ভাঙে। বলে, বোন, অ- রে বোন, বাথরুমে গেছিলি?
না ঠাকুরমা।
গোলাগুলি হচ্ছে মনে হয়।
গোলাগুলি নয়। পাড়ার ছেলেরা বাজি পুড়াচ্ছে।
এতো রাতে বাজি! কেনরে বোন?
কাল বিজয় দিবস না?
ওহ তাই। এখন ঘুমা।
হৃদি দেয়াল ঘড়িটার দিকে দৃষ্টি ফেলে। ডিমলাইটের আলোয় কাঁটাগুলো অস্পষ্ট। চোখজোড়ায় তার ঘুম আসছিল না। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিল। দাদুর কথা খুব মনে পড়ছে। দাদুকে কখনো সে দেখেনি। যখন তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন তার বাবা ছিল দুই বছরের শিশু। বাবা কখনও এসব গল্প বলেননি। দাদুর যত গল্প শুনেছে ঠাকুরমার মুখে। দাদুকে নিয়ে তার অনেক গর্ব।
হৃদি মিনতি দেবীর আবারও গা ঠেলে। বলে, ঠাকুরমা, ও ঠাকুরমা ঘুমিয়ে পড়ছ নাকি?
আচমকা ধড়ফড়িয়ে ওঠেন মিনতি দেবী। চেঁচিয়ে বললেন, কিরে-এখনো ঘুমাস নাই? কাল না তোর পরীক্ষা?
পরীক্ষা? তুমি কি পাগল হয়েছ? বাবাকে বলব, ডাক্তার দেখাতে?
ডাক্তার? কেন রে?
তোমাকে ক’বার বলেছি, ছয় তারিখ আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে।
মনে রাখতে পারি না, বোন। সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। এখন শুয়ে পড়।
মিনতি দেবী নিশ্চুপ, নিশ্চল। রাত তখন একটার কাঁটা ছুঁই-ছুঁই। হৃদি আবারও গা ঠেলে, ঠাকুরমা, ও ঠাকুরমা?
কি হয়েছে বোন? শান্তিতে ঘুমাতে দিবি?
ঠাকুরমা, একটি গল্প শুনবো
গ … ল্প? এত রাতে?
প্লিজ ঠাকুর মা, বলো না। ঐ ৭১ … দুই রাজাকার।
কাল শুনিস্ রে বোন। মাথাটা ভার হয়ে আছে।
প্লিজ ঠাকুর মা। শুধু একবার। দ্বিতীয়বার বিরক্ত করবো না। হৃদির অনুনয়-বিনয়। মিনতি দেবী ওঠে বসেন। বেডসুইচ হাতড়ে হৃদি আলো জ্বালায়। পাশের ঘর থেকে পানের বাটাখানি এনে তুলে দেয় ঠাকুরমার হাতে। মিনতি দেবী চুন, জর্দা, সুপারি মিশিয়ে একটি পান মুখে পুরেন। শুরু করেন সেই বীভৎস দিনের কথা।
সংবাদ পেলাম উনি মারা গেছেন। মৃত মানুষটির জন্য একটু কাঁদবো, সেই শক্তিও আমার ছিল না। এভাবে তিন-তিনটা দিন পার হলো। তোর বাবা-পিসিদের খাবার শেষের দিকে। হাতে নেই কোনো টাকা-পয়সা।
তার মধ্যে ওই বাসার জমিদার এলো। সে ছিল বিহারি। সমবেদনা জানাতে গিয়ে বলল, মিনু, এ ক’দিন তোমার শোকের ভেতর দিয়ে দিন যাচ্ছে। এতিম বাচ্চাগুলোর দিকেও তাকানো যাচ্ছে না। কিন্তু কীভাবে বলবো, তা-ও বুঝছি না। আবার না বলেও নিশ্চুপ থাকতে পারছি না। তখন ওই মহিলাকে বললাম, খালাম্মা, আপনি নিঃসংকোচে বলুন।
তারপরও বলতে লজ্জা করছে।
বলুন, সমস্যা নেই।
বাবু গেল মাসের ভাড়া দেয়নি। বলেছিল এই মাসের দশ তারিখ দিয়ে আসবে। তার আগে সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। হন্যে হয়ে খুঁজলেও তারে পাবো না।
খালাম্মা, আপনি ভাড়ার জন্য কোন টেনশন করবেন না। বাবুর একটা সাইকেল আর রেডিওটা আছে। আপাতত ওগুলো নিয়ে যান।
না-না, তা কি করে হয়? বর্তমানে যা অবস্থা দেখা যাচ্ছে। এসব নিয়ে আমি কোথায় যাবো? কার কাছে বিক্রি করবো?
আপা, ট্রাংকে কিছু বিয়ের স্বর্ণালংকার আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে সেসব বিক্রি করে আপনার সব ভাড়া মিটিয়ে দেবো।
আমতা আমতা করে ওই মহিলা বললো, স্বর্ণ কতো ভরি হবে?
প্রায় তিন ভরির মতো।
ওহ তাই! বাবু নেই। এসব জিনিস ঘরে রাখা তোমার জন্য নিরাপদ নয়। তার চেয়ে বরং আমাকে দাও। সযতেœ সিন্দুকে রাখবো।
উনি চাইলো আর তুমিও দিয়ে দিলে, এই তোÑ হৃদি বলল।
কী করবো বোন? ওই পরিস্থিতিতে কি এসব খেয়াল ছিল! সরল বিশ্বাসে সব স্বর্ণ তাকে দিয়ে দিই। সে নিয়ে বাসায় ফিরে যায়। পরদিন আবারও আসে। বলে, বাসা ছেড়ে দিতে। তার হাত চেপে ধরে অনুনয়-বিনয় করলাম। বললাম, খালাম্মা, ক’দিন আগে আমার বাচ্চারা তাদের বাপকে হারাল। এই খুলনা শহরে কোনো আত্মীয়স্বজন নাই। বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কোথায় যাবো? আমার আকুতি ওই মহিলার কানে পৌঁছাল না। সময় বেঁধে দিল। বাসা ছেড়ে দিতে হবে। নয়তো বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে যাবে।
তারপর কি করলে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন মিনতি দেবী। বোন, কিছুই করার ছিল না। তোর দাদুর সাইকেল-রেডিও এবং স্বর্ণালংকার সব তার কব্জায় নিয়ে আমাদের বের করে দিল।
তুমি প্রতিবাদ করলে না?
যেখানে একটা জলজ্যান্ত মানুষ হারিয়ে গেল কিছুই করতে পারলাম না। আবার প্রতিবাদ?
তারপর কি করলে?
তোর বাবাকে কোলে আর তোর ছোট পিসিকে বালতিতে পুরে বেরিয়ে পড়লাম।
বড় পিসি?
তোর বড় পিসিকে একহাত কাপড়ের আঁচল দিয়ে বেঁধে নিলাম।
আচ্ছা ঠাকুরমা,ছোট পিসির তখন বয়স কত ছিল?
তিন সাড়ে তিন মাস হবে।
তারপর?
এরাস্তা-ওরাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। যাকে সামনে পাই হাত পাতি। কেউ দেয়, কেউবা মুখের দিকে তাকিয়ে এড়িয়ে যায়। রাত তখন গভীর হচ্ছিল। চারপাশ থমথমে। চারদিক লাশ আর লাশ। দুই-একটা গাড়ি আসতে দেখে বালতির ওপর বুক পেতে তোর বাবা-পিসিদের আড়ালে রাখতাম। পা দুটো চলছিল না। তোর বড় পিসি …
থামলে কেন? কী হয়েছিল বড় পিসির?
আঁচলের কোনায় চোখ মুছলেন মিনতি দেবী। এরপর বললেন, তোর বড় পিসি বাবার জন্য খুব কাঁদছিল। তাকে নানাকথা বলে সান্ত¡না দিচ্ছিলাম। রাস্তার ধারে দেখলাম, একটা পোড়াগাড়ি। নিকট দূরত্বে ছিল একটি পোড়া লাশ। সেখানে তাদের রেখে খাবার খুঁজছিলাম। অন্যদিক হতে দুটো লোক এসে পথ আটকালো। একজন বলল, দিদি, ও দিদি। কি খুঁজছ? বললাম, ভাই, খাবার খুঁজছি। বাচ্চাগুলো ক্ষুধার্ত। খুব কান্নাকাটি করছে। অন্য লোকটি বললো, দিদি, এসো আমাদের সাথে। তোমাকে খাবার যোগাড় করে দেবো।
তারপর?
তাদের পিছু নিলাম। আচমকা একটি গাড়ি এসে থামে আমাদের সামনে। ওই গাড়ি থেকে দু’জন লোক হুটহাট করে নেমে আসে। আমাকে ঝাপটে ধরে। ওই লোক দুটোর একজন তাদের কি যেন বলল। আমি কাঁদতে থাকি। ওরা মানছিল না। তুলে নিয়ে যাবেই যাবে। এমন সময় গাড়ির ভেতর হতে দৈত্যের মতো এক গোঁফওলা লোক নেমে আসে। চোখে তার রঙিন চশমা। তার পায়ের ওপর গিয়ে আছড়ে পড়ি। কেঁদে বলি, ভাই, ক’দিন আগে আমার স্বামীকে হারিয়েছি।
ওই ওই যে পোড়া গাড়িটি দেখছেন না। তার সামনে আমার বাচ্চাগুলোকে রেখে এসেছি। তাদেরও নিয়ে আসি। মারবেন যখন সবাইকে এক সাথে মারেন। কেন জানি, ওই লোকটির দয়া হলো। দৈত্যের মতো লোকটি পাশের লোকটিকে বলল, এই খানসাব, লেড়কিকো ছোড় দো…
তারপর?
ঐ চশমাপরা লোকটি বলল, ব্যাহেন, আপ ইয়াসে বহোত দূর চলে যাও।
তারপর?
গাড়িখানি অদৃশ্য হলো। আমি ছুটে যাই তোর বাবা-পিসিদের কাছে। প্রায় সাত-আটটি মাস তাদের নিয়ে খুলনা শহরের এরাস্তা-ওরাস্তা, এ গলি-ওগলি চষে বেড়াই। এরপর দেশ স্বাধীন হয়। চারদিক হতে কত আনন্দমিছিল আসছিল-যাচ্ছিল। বারবার ভগবানকে স্মরণ করছিলাম, তোর দাদু যেন ওই আনন্দে
মিছিলের ভিড়ে থাকে। কিন্তু নাহ! সেই যে তিনি গেলেন একটি মুহূর্তের জন্য দ্বিতীয়বার আর ফিরে এলেন না। একটি দীর্ঘশ্বাস আবারও বেরিয়ে আসে মিনতি দেবীর বুকের অতল হতে। তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
হৃদির গল্প শোনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মধ্যরাতে মিনতি দেবীর কান্নার ভারে হৃদিরও বুকও ভারী হয়ে ওঠে। আবেগ তাড়িত হয় সেও। ভিজে ওঠে তার দুচোখের পাতা। বিড় বিড় করে বলে, কুত্তার বাচ্চা!