সাফাত বিন ছানাউল্লাহ্ »
খ্যাতিমানদের যুগে যুগে মানুষ স্মরণ করে। তাঁদের রেখে যাওয়া কর্মগুলো থেকে নব প্রজন্ম আগামীর চলার পথে সুন্দর জীবন গঠনের উৎসাহ খুঁজে। ইতিহাস ঐতিহ্যের সূতিকাগার বীর চট্টলার সৎ ও ত্যাগী রাজনীতিবিদ, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, অবিভক্ত চট্টগ্রাম জিলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও দপ্তর সম্পাদক মরহুম মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকী ইতিহাসের অংশ। পৃথিবীর নিয়মে তিনি না থাকলেও আপন কর্মে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।
১৯৩৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি পটিয়ার ফারুকী পাড়াতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, আলেমেদ্বীন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা খলিলুর রহমান ফারুকী। তিনি ছিলেন চট্টলগৌরব, উপমহাদেশখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, গ্রন্থপ্রণেতা ও ইসলামী চিন্তাবিদ, নিখিল ভারত কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী।
প্রাথমিক শিক্ষার গ-ি পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পড়া অবস্থায় বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন ১৯৪৯ সালে মিয়া ফারুকী পটিয়ার স্থানীয় কমিটিতে যোগ দেন। পরে দলের সদস্য থেকে সাধারণ সম্পাদক, পর্যায়ক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালে অবিভক্ত চট্টগ্রাম জিলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও ১৯৬৯ সালে দপ্তর সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর নিযুক্ত করেন। ১৯৫৮ সালে রাজনীতির উত্তাল আন্দোলনের সময় পাক সামরিক সরকারের পুলিশ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে ১ মাস ১৩ দিন কারাভোগ করেন।
১৯৬৬’র ছয়দফা আন্দোলনে হরতালের সময়ও গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। পরবর্তীতে আরো ৩-৪ বার তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। একটা সময় ছিল যখন তিনি দেশমাতৃকার টানে চষে বেড়িয়েছেন টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয় ভূমিকায়। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয়দফা প্রচারের ক্ষেত্রে তিনি পালন করেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা।
১৯৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। পাকিস্তানি হায়েনার দল পটিয়ার ফারুকী পাড়ার বাড়িতে এসে তাঁকে না পেয়ে ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং আশেপাশের অনেককেই হত্যা করে। তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে মিয়া ফারুকীকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ১০হাজার টাকা পুরস্কার ও ঘোষণা করেছিলো।
রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি পরিবারের খোঁজখবর পর্যন্ত নিতে পারেননি। সহধর্মিণী রতœগর্ভা মহীয়সী নারী মরহুমা রোকেয়া বেগম আগলে রেখেছেন পাঁচ কন্যা ও দুই পুত্রসন্তানকে। জনাব মিয়া ফারুকীর চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় একটি বিখ্যাত লাইব্রেরি ছিল “চট্টল লাইব্রেরি”। লাইব্রেরিটি ছিল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে তখনকার আওয়ামী লীগের অঘোষিত কার্যালয়। চট্টগ্রাম সহ দেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও কৃতি ব্যক্তিত্বদের মিলনস্থল ছিল এটি। চট্টল শার্দূল এম. এ. আজিজ কাছের মানুষ হিসেবে মিয়া ফারুকীকে সবসময় সাথে রাখতেন। সেই সুবাদে মিয়া ফারুকী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আস্থাভাজন হন। এম. এ. আজিজ কোনো এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, মিয়া ফারুকী বেশ ভালো বক্তা। এর পর থেকেই চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বক্তা হিসেবে নিয়ে যেতেন।
১৯৬৭ সালে বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিবাহোত্তর সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল চট্টগ্রামে এম এ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আব্দুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী, এম এ হান্নান সহ তৎকালিন নেতাদের সাথে সেই অনুষ্ঠানটির অন্যতম আয়োজক ছিলেন তিনি।
১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মর্মান্তিক হত্যাকা-ের পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। লেখালেখির মাধ্যমে তিনি শুদ্ধ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। বীর চট্টলার এই কিংবদন্তীতুল্য মহাপুরুষ রাজনীতি, লেখালেখি ও সমাজকর্মের জন্য পুরস্কার, স্বর্ণপদক পেলেও জীবদ্দশায় পাননি কোন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা।
প্রচারবিমুখ মানুষটি আজীবন কলমের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়। তাঁর লেখা প্রায় শতাধিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ দেশের বিভিন্ন পত্র- পত্রিকা, ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে।
মিঞা ফারুকীর রাজনৈতিক জীবন, তাঁর ত্যাগ, শ্রম থেকে রাজনৈতিক কর্মীরা শিক্ষা নিয়ে দেশমাতৃকার সেবায় অবদান রাখতে পারেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : প্রাবন্ধিক