ভারতের সঙ্গে রুপির বাণিজ্য গতি পেতে কেন ব্যর্থ

সুপ্রভাত ডেস্ক »

এক বছরেরও বেশি সময় আগে ভারতের সঙ্গে ডলারের বদলে রুপিতে আমদানি-রপ্তানির সুযোগ চালু হলেও সেটি খুব বেশি আশা দেখাতে পারছে না।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের নতুন এই পদ্ধতি চালু করা হলেও লেনদেনের পরিসংখ্যান বলছে, ভারতীয় মুদ্রায় ব্যবসা হয়েছে তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মুদ্রায় ৩৩.০৮ মিলিয়ন রুপির রপ্তানি হয়েছে। আর একই সময়ে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ২১.০২ মিলিয়ন রুপির।
রুপিতে আমদানি-রপ্তানির মোট যোগফল ডলারের অঙ্কে ১ মিলিয়নেরও কম। অথচ ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে ২.০২ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের রপ্তানি এবং ১৪ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের আমদানি করেছে। অর্থাৎ, প্রতি বছর অন্তত ২ বিলিয়ন সমপরিমাণ রপ্তানির অর্থ রুপিতে করার সুযোগ ছিল। তবে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ না থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইস্টার্ন ব্যাংকের (ইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আলী রেজা ইফতেখার টিবিএসকে বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের আমদানি ও রপ্তানির পার্থক্য ১২-১২.৫ বিলিয়ন ডলার। রুপিতে ট্রেড শুরু করার পর ব্যবসায়ীদের কম আগ্রহ, ইমপোর্ট রেস্ট্রিকশনসহ অনেক কারণে সেটি আর ঠিকমতো আগায়নি।’
‘কারণ, অনেক ব্যবসায়ী ভারতে রপ্তানি করলেও, তাদের আবার অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে তাদের আমদানির পেমেন্ট ডলারে করতে হয়। এতে করে রুপিতে ট্রেড করলে ব্যবসায়ীদের কারেন্সি কনভার্সনে কিছুটা লাভ হলেও তারা ডলারে ট্রেড করাতেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে,’ বলেন তিনি।
গত ছয়মাসে রুপিতে উল্লেখযোগ্য কোনো ট্রেড হয়নি বলেও মন্তব্য করেন এই ব্যাংকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডলার সংকট যখন শুরু হয়, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বদলে ভারতের সঙ্গে বিকল্প বাণিজ্যের ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিল। রুপিতে বাণিজ্যের ভিত্তি ছিল— ভারতে রপ্তানি করলে রুপি আয় হবে এবং ভারত থেকে কোনো কিছু আমদানি করতে চাইলে আয় করা সেই রুপি দিয়েই আমদানির এলসির পেমেন্ট করা যাবে।
‘যেহেতু ভারতে রপ্তানি কম হয়, তাই রুপিও কম আসে। সেজন্য অনেক আমদানির পেমেন্ট চাইলেও রুপিতে করা যায় না,’ যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে ব্যাখ্যা করেন, ‘ভারতে যেসব পণ্য রপ্তানি করা হয়, এগুলোর মধ্যে অনেক কাঁচামাল মালয়েশিয়া, চীন বা অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে আমাদের এসব ইমপোর্ট পেমেন্ট করতে হয় ডলারে। এমনকি, কাঁচামাল লোকালি ইমপোর্ট করলেও আমাদের ডলারে পেমেন্ট করতে হয়।’
‘এখন আমি এক্সপোর্ট পেমেন্ট যদি রুপিতে পাই, সেটাকে প্রথমে টাকায় কনভার্ট করতে হবে। পরে সেই টাকা দিয়ে ডলার কিনে ইমপোর্ট পেমেন্ট করতে হবে। ফলে আমাদের দুইবার কনভার্সন লস হয়। ডলারে এক্সপোর্ট করলে আমাদের এই লসটা হয় না। এ কারণেই রুপিতে ট্রেড করায় ব্যবসায়ীরা কম আগ্রহ দেখাচ্ছেন,’ যোগ করেন তিনি।
যেভাবে যাত্রা শুরু এবং থমকে যাওয়া
২০২৩ সালের ১১ জুলাই ভারতের সঙ্গে টাকা–রুপিতে বাণিজ্য শুরু হলে, বাংলাদেশের পক্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক এবং বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ভারতের সাথে পণ্য আমদানি–রপ্তানিতে ডলারের পরিবর্তে রুপিতে এলসি খোলার অনুমতি পায়। এরপর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকও এর অন্তর্ভুক্ত হয়।
এসব ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ও ইসলামী ব্যাংক থেকে রুপিতে কোনো ধরনের আমদানি ও রপ্তানি করা হয়নি।
এক বছরের বেশি সময় ধরে ইস্টার্ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে রুপির মাধ্যমে বাণিজ্য হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ইবিএল এর মাধ্যমে আমদানি হয়েছে ১.১৩ মিলিয়ন এবং রপ্তানি হয়েছে ৭.৩৫ মিলিয়ন রুপির।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি হয়েছে ৪.৮১ মিলিয়ন এবং রপ্তানি হয়েছে ৯.৬৩ মিলিয়ন রুপির।
এছাড়া, স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার মাধ্যমে আমদানি হয়েছে ১৫.০৮ মিলিয়ন এবং ১৬.১ মিলিয়ন রুপির রপ্তানি হয়েছে।
বাংলাদেশে স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার কান্ট্রি হেড অমিত কুমার টিবিএসকে বলেন, ‘২০২৩ সালের জুলায়ে আমরা নিটল নিলয় গ্রুপের সাথে যানবাহন আমদানি এবং অপরিশোধিত সয়া তেল রপ্তানির জন্য একটি এলসি খুলেছিলাম। প্রথম তিন মাসে আমদানি বাবদ ১৬.১ মিলিয়ন এবং রপ্তানিতে ১২.৪ মিলিয়ন রুপির মোট চারটি এলসি খোলা হয়েছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গতবছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে ব্যাংকটি নতুন করে রুপিতে আর কোনো রপ্তানি করেনি। এর পরের এক বছরে ব্যাংকটির মাধ্যমে আমদানি করা হয়েছে মাত্র ২.৫ মিলিয়ন রুপির।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে কোনো পণ্য আমদানি করতে হলে দেশের ব্যাংকে রুপিতে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে হবে। কিন্তু বাস্তবে ব্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত রুপি নেই। দেশ থেকে রুপিতে রপ্তানি হলেই ব্যাংকগুলোতে রুপি আসবে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানিও কম, তাই রপ্তানির বিপরীতে রুপি আসেও কম; যা করছে তাও যৎসামান্য।
ঢাকার একটি হোটেলে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে রুপিতে বাণিজ্যের কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিষয়টিকে একটি ‘বড় সূচনার প্রথম পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
বিদেশি মুদ্রা লেনদেনে আর্থিক পরিষেবা হিসেবে আন্তর্জাতিক লেনদেন মাধ্যম সুইফট সিস্টেমকে ব্যবহার করা হয়। কোনো দেশের সঙ্গে বিদেশি মুদ্রায় বাণিজ্য লেনদেন নিষ্পত্তি করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দ্বারা স্বীকৃত মুদ্রায় করতে হয়। সুইফট সিস্টেমে এখনও রুপি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মার্কিন ডলার, ইউরো, পাউন্ড, চীনের মুদ্রা ইউয়ান ও জাপানের ইয়েন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের স্বীকৃত মুদ্রা। এর বাইরের কোনো মুদ্রায় লেনেদেন করতে হলে প্রয়োজন হয় দ্বিপক্ষীয় চুক্তির। বাংলাদেশ ও ভারত সেটিই চালু করেছিল। সূত্র: টিবিএস