বিবিসি »
নরেন্দ্র মোদী ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে মূলত ঝড় তুলেছিলেন তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে– কর্মসংস্থান, উন্নতি আর লাল ফিতার দৌরাত্ম কমানো।
২০১৪ ও ২০১৯ সালে তার বড় বিজয় বড় ধরণের সংস্কারেরও আশা তৈরি করেছিলো।
কিন্তু তার অর্থনৈতিক রেকর্ড বলছে তার সাত বছরের প্রধানমন্ত্রীত্ব আসলে হতাশাকেই উস্কে দিয়েছে।
আর এতে আরও আঘাত করেছে করোনা মহামারি।
প্রবৃদ্ধির ধীরগতি
নরেন্দ্র মোদী ২০২৫ সালের মধ্যে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিলেন ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বা মুদ্রাস্ফীতির সাথে সমন্বয়ের পরেও কমবেশি ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কিন্তু করোনা পূর্ববর্তী পর্যালোচনায় দেখা গেছে সেটি সর্বোচ্চ আড়াই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে। মহামারির কারণে কমতে পারে আরও অন্তত ২-৩শ বিলিয়ন ডলার।
মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, তেলের বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধিও এখন একটি বড় উদ্বেগের বিষয় বলে বলছেন অর্থনীতিবিদ অজিত রানাদে।
তবে এমন পরিস্থিতির জন্য কোভিডই এককভাবে দায়ী নয়।
মি. মোদী যখন ক্ষমতায় আসেন তখন ভারতের জিডিপি ছিলো ৭-৮ শতাংশ, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ তিন মাসে সেটি নেমে আসে ৩.১ শতাংশে।
২০১৬ সালের আলোচিত মুদ্রা নিষেধাজ্ঞা যা অর্থ প্রবাহ থেকে ৮৬ শতাংশ নগদ অর্থ সরিয়ে নেয়, আর ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স’ বা জিএসটি নামে নতুন এক কর ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় আঘাত করে।
আর এগুলোই নতুন বড় বড় সমস্যার সূত্রপাত করে।
চাকুরী হারানোর সংখ্যা বাড়ছেই
সেন্টার ফর মনিটরিং অব দা ইন্ডিয়ান ইকোনমির সিইও মহেশ ভায়াস বলছেন ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো ২০১১-১২ সাল থেকে বিনিয়োগের নিম্মমুখী প্রবণতা।
“এরপর ২০১৬ সাল থেকে আমাদের আরও কয়েকটি অর্থনৈতিক আঘাত সইতে হয়েছে”।
মুদ্রা নিষেধাজ্ঞা, জিএসটি ও মাঝে মধ্যে লকডাউন- এসব কিছুই কর্মসংস্থান কমিয়েছে, তিনি বলছিলেন।
বেকারত্ব ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয় ২০১৭-১৮ সালে। আর ২০২১ সালের শুরুতে এসে অন্তত আড়াই কোটি মানুষ কাজ হারায় আর দারিদ্রসীমায় ঢুকে যায় আরও সাড়ে সাত কোটি মানুষ।
মিস্টার রানাদে বলছেন একই সময়ে প্রতি বছর যে ২ কোটি কাজের সুযোগ তৈরি করা দরকার সেখান থেকেও অনেক দূরে মোদী সরকার।
গত এক দশকে প্রতি বছর মাত্র ৪৩ লাখ কাজের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, বলছিলেন তিনি।
রপ্তানিতে ভাটা
মি. মোদীর সবচেয়ে বড় শ্লোগান ছিলো ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ যার লক্ষ্য ছিলো লাল ফিতার দৌরাত্ম কমিয়ে আর বিনিয়োগ বাড়িয়ে ভারতকে বৈশ্বিক উৎপাদকে পরিণত করা।
যার লক্ষ্য ছিলো এ খাত থেকে জিডিপির ২৫ শতাংশ নিশ্চিত করা কিন্তু গত বছরে এটি আটকে আছে পনের শতাংশে।
আর সবচেয়ে খারাপ খবর হলো এ খাতে কাজের সংস্থান গত পাঁচ বছরে কমে অর্ধেক হয়েছে।
এক দশক ধরে রপ্তানি আটকে আছে তিনশ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে।
বরং প্রধানমন্ত্রী মোদীর সময়েই বাংলাদেশের মতো ছোট কিছু প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে কিছু বাজারের অংশীদারিত্ব ক্রমান্বয়ে হারিয়েছে ভারত।
অবকাঠামো নির্মাণ
অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান ফিডব্যাক ইনফ্রার সহ প্রতিষ্ঠাতা ভিনায়ক চ্যাটার্জি বলছেন, মি. মোদীর সরকার প্রতিদিন গড়ে ৩৬ কিলোমিটার সড়ক তৈরির কাজ করেছে যা আগের সরকারের সময়ে ছিলো ৮-১১ কিলোমিটার।
নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ দ্বিগুণ হয়েছে গত পাঁচ বছরে। এখন একশ গিগাওয়াট উৎপাদন হলেও ২০২৩ সাল নাগাদ লক্ষ্য হলো ১৭৫ গিগাওয়াট।
অর্থনীতিবিদরা অনেকেই মিস্টার মোদীর জনপ্রিয় প্রকল্প যেমন লাখ লাখ নতুন টয়লেট তৈরি করা, গৃহ ঋণ, গরীবের জন্য গ্যাস ও পানিতে ভর্তুকি- এগুলোর প্রশংসাই করেন।
যদিও বহু টয়লেটই ব্যবহৃত হচ্ছে না বা পানি সরবরাহ নেই আর ভর্তুকির যে সুবিধা পেত মানুষ তাকে সংকটে ফেলেছে তেলের দাম বৃদ্ধি।
অর্থনীতির মুল ধারায় যুক্ত হচ্ছে অনেক মানুষ
এটাকে মোদী সরকারের বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ডিজিটাল পেমেন্টের ক্ষেত্রে ভারত এখন বৈশ্বিক নেতাদের একটি। মিস্টার মোদীর জন-ধন যোজনা বিপুল পরিমাণ গরীব মানুষকে ব্যাংকিং ধারায় যুক্ত করেছে।
ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট ও ডিপোজিট বেড়েছে যদিও অনেক অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়
অর্থনীতিবিদ রিতিকা খেরা বলছেন, “আগের সরকারের মতো এই সরকারও স্বাস্থ্যসেবায় অবহেলা অব্যাহত রেখেছে। ভারত বিশ্বের যেসব দেশ স্বাস্থ্যসেবায় খুব কম ব্যয় করে তার একটি”।
তিনি বলছেন যুক্তরাষ্ট্র স্টাইলের একটি স্বাস্থ্য-পদ্ধতির দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
আর মিস্টার মোদীর উচ্চাভিলাষী হেলথ ইনস্যুরেন্স প্রকল্প, যা ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করেছে, কার্যত এই কোভিডের সময়েও অব্যবহৃত।
কৃষি খাতে করণীয় অনেক কিছুই বাকী
ভারতের কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই দেশটির কৃষিখাতে সম্পৃক্ত কিন্তু এটি জিডিপিতে অবদান রাখে কমই।
এজন্যই অনেকে মনে করেন ভারতের কৃষিখাতের সংস্কার দরকার।
কৃষিখাত সম্পর্কিত নতুন একটি আইন নিয়ে মাসের পর মাস প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছে কৃষকরা কারণ তাদের ভয় যে তারা আরও আয় হারাবেন।
মিস্টার মোদী অবশ্য এটি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তবে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আর রামাকুমার বলছেন, সরকারের উচিত কৃষিকে সাধ্যের মধ্যে আনা ও আর লাভজনক করতে আরও অর্থ ব্যয় করা।
“নগদকরন সাপ্লাই চেনকে ধ্বংস করেছে আর জিএসটি ২০১৭ সালে মূল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। আবার কোভিড লকডাউন-জনিত অর্থনৈতিক ব্যথা উপশমে সরকার কমই কাজ করেছে,” তিনি বলছেন।
মি. রানাদে বলছেন সমাধান কিছুটা কৃষির বাইরে। “অন্য খাতগুলো উদ্বৃত্ত শ্রমিকের ভার নিতে পারলে কৃষি ভালো করে”।
কিন্তু সেটি হওয়ার জন্য দরকার ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ, যা এখন ১৬ বছরের মধ্যে কম। – আর বিশেষজ্ঞদের মতে এটি মোদী সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ।