ব্যাটারি রিকশা বন্ধে যতসব খোঁড়া যুক্তি

আহমদ জসিম »

ব্যাটারি  রিকশা প্রসঙ্গে আলাপটা শুরু করতে গিয়ে আমার প্রথমেই মনে পড়ে একটা বহুল প্রচলিত  প্রবাদ, ুকাজীর গরু খাতায় আছে গোয়ালে নেই”। অবশ্য এখানে ঘটেছে ঠিক উল্টোটা, ব্যাটারি রিকশাকে যদি আমরা গরু ধরি সেটা দিব্যি আছে, কিন্তু সেটা আবার খাতায় নেই, অর্থাৎ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নেই। অথচ এই পরিবহনটা একেক অঞ্চলে একেক নাম দিয়ে যেমন, বিবাটেক, করিমন, নসিমন, আলম সাধু, বটবটি ইত্যাদি নামে চলছে। সারাদেশে প্রায় ৬০ লক্ষ গাড়ি চলছে, এই ৬০ লক্ষ গাড়িকে কেন্দ্র করে জীবন চলছে প্রায় ৩ কোটি মানুষের। এত কর্মযজ্ঞ, এত মানুষের জীবন-জীবিকার ব্যাপার, আমার ধারণামতে কৃষি ও অভিবাসী শ্রমিকের পরেই দেশে কর্মসংস্থানের এটা তৃতীয় খাত, এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ যোগান দেয় যে গার্মেন্টস শিল্প সেখানেও তো এত মানুষের কর্মসংস্থান হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো, গরীব মানুষগুলো নিজ উদ্যোগে যে কর্মসংস্থান তৈরি করেছে সেটা ধ্বংস করার জন্য রাষ্ট্র এমন খড়গহস্ত  কেন? এই কেন-র জবাব দিতে গিয়ে সরকার আমাদের সামনে কিছু তথ্য হাজির করে, তথ্যগুলো মোটামুটি এইরকম:
১.  ব্যাটারি রিকশা সড়কে যানজট ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করে
২. সড়কে দুর্ঘটনা ঘটায়
৩. ত্রুটিপূর্ণ ফলে নিরাপদ নয়
৪. বিদ্যুৎ অপচয করে।
একটা মজার বিষয় হলো, এক/ দুদিনে কিন্তু এতগুলো ব্যাটারি রিকশা রাস্তায় নামেনি, অনেক বছর রাস্তায় চলার পর একটা কর্পোরেট গোষ্ঠীর যখন এই ব্যাটারি রিকশাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা করার লোলুপ দৃষ্টি গেল, তখন থেকেই মূলত রাষ্ট্র প্রশাসন এই ব্যাটারি চালিত রিকশার মালিক-চালকদের ওপর অধিকতর খড়গহস্ত হয়ে ওঠে! ওই ব্যবসায়ীক গোষ্ঠী প্রথমে আদালতকে ব্যবহার করে তাদের ব্যবসায়ীক স্বার্থ উদ্ধার করতে চেয়েছে, এবং সড়কে বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার কথা বলে সুপ্রিমকোর্ট থেকে একটা নিষেধাজ্ঞাও আদায় করে নিতে পেরেছে। পরে ব্যাটারি রিকশার সংগঠন সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে মাননীয় আদালত বিপুল মানুষের রুটিরুজির কথা চিন্তা করে, একটা নীতিমালার  অধিনে গাড়িগুলো বিআরটিকে অনুমোদনের কথা বলেন এবং ২২টা মহাসড়ক  ব্যতিত অন্য সড়কে গাড়িগুলো চলাচলের অনুমতি দেন।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সর্বোচ্চ আদালতের রায় হচ্ছে আইন, কিন্তু এই আইন সবার আগে যাদের মান্য করার কথা, সেই পুলিশ প্রশাসন তো থোড়াই কেয়ার করে, ওই যে কথায় বলে না গরিবের বউ সকলের ভাবি, যেহেতু এই ব্যাটারি রিকশার সাথে যুক্ত মালিক-চালকরা গরিব শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে তাই, পুলিশ এটাকে অবৈধ হিসেবে অবহিত করে এবং দমন-পীড়নে ছাড়িয়ে যায় সহ্যের সীমা।
পুলিশ প্রশাসনের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের প্রধান উৎস হচ্ছে ব্যাটারি রিকশা প্রশ্নে রাষ্ট্রের নীতি। এখন যে অভিযোগগুলো দাঁড় করিয়ে ব্যাটারি রিকশা অনুমোদনে অনিহা প্রকাশ করছে, আমরা সেই অভিযোগগুলো একটু নিরীক্ষা করে দেখি। প্রথমেই আসা যাক, সড়কে যানজট আর বিশৃঙ্খলা তৈরি প্রসঙ্গটা নিয়ে, আলাপটা শুরু করছি একটা ভয়াবহ তথ্য দিয়ে,  সাম্প্রতিককালে দেশের একটা প্রধান দৈনিক রিপোর্ট প্রকাশ করছে, ঢাকা নগরে যানজটের ফলে প্রতিদিন যে শ্রম ঘন্টার অপচয় হয়, বছর শেষে তার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা! ঢাকা নগরের যে অংশে নিত্য যানজট লেগে থাকে সেখানে কিন্তু ব্যাটারি রিকশা চলে না, ব্যাটারি রিকশা চলে শহরের অলিগলিতে, তবে এই যানজটের দায় কার? বিআরটিসি থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা শহরে মোট ৩ লক্ষ প্রাইভেট গাড়ি চলে, যে গাড়িগুলো শহরের ৭৬ ভাগ রাস্তা দখল করে আছে, অথচ এই গাড়িগুলোকে নগরের মাত্র তিন ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, অন্যদিকে এই ঘনবসতিপূর্ণ নগরের জন্য রাষ্ট্রের যে পরিকল্পিত গণপরিবহন সিস্টেম গড়ে তোলার কথা ছিল, তার ধারেকাছেও যায়নি কোনো সরকার। একদিকে বড়লোকদের বিলাস প্রাইভেট গাড়ি, অন্যদিকে পরিকল্পিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে রাষ্ট্রের  ব্যর্থতা, দুইটারই দায় চাপানো হচ্ছে ওই ব্যাটারি রিকশার চালক-মালিকদের ওপর! আর সড়কে বিশৃঙ্খলার কথা বলবেন? সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্ট কিন্তু ট্রাফিক সিস্টেম, তারপরও বলি, দেশে যে ভারী যানবাহনগুলো চলে তার ৩৭ শতাংশই হলো মেয়াদ উত্তির্ণ । একটা গাড়িকে ২৫ বছর মেয়াদ হিসেবে করে, কোনো কোনো গাড়ি ৪৫/৫০ বছর পর্যন্ত সড়কে চলছে!  সচেতন মহলের নানা অংশ থেকে এই ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো সড়ক থেকে তুলে নেওয়ার দাবি করা হয়, কিন্তু গাড়িগুলো সড়ক থেকে সরানো যাচ্ছে না। কেন? কারণ মালিক সমিতির চাপ, এই মালিক সমিতির ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, বরং যে দল ক্ষমতায় আসে তাদের ওপরেই এই সংগঠন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে!
এবার আসা যাক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে, দৈনিক বণিক বার্তা পত্রিকা চলিত বছরের ৯ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেই প্রতিবেদনের তথ্য মতে দেশে বিগত ২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৫৩৮০ মানুষের, এই প্রতিবেদনে কোন যানবাহন দুর্ঘটনায় কত পারসেন্ট মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান হাজির না করলেও, মৃত্যুর এই ক্রমবর্ধমান হারের জন্য দায়ী করা হয়েছে, নিরাপদ সড়কের জন্য বিশেষজ্ঞগণ যে সুপারিশ করেছে তার কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করতে না পারা। সেই সাথে উল্লেখ করা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সর্বোচ্চ কারণ হচ্ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। তাহলে এখন তো মোটরসাইকেলও বন্ধ করে দেওয়ার দরকার আছে! কী অদ্ভুত ও হাস্যকর দাবি, লক্ষ করুন, বলা হচ্ছে যেহেতু ক্রটিপূর্ণ নকশা তাই এটা সড়কে চলাচলের জন্য নিরাপদ নয়, তাদের কথা শুনে মনে হয়, এটা কোন মানুষের হাতে তৈরি হয়নি, ওহির মতো আসমান থেকে নাজির হয়েছে, তাই এটা পরিবর্তন সম্ভব নয়! খেয়াল করুন, রাইট ভাইয়েরা যে বিমান বানিয়েছিল, সেটা এখন আর কোনো বোয়িং কোম্পানির হাতে নেই, বড়জোর যাদুঘরে থাকতে পারে। প্রকৌশলবিদ্যা দিয়ে যদি বিমান পাল্টে ফেলা যায়,  তা হলে একই বিদ্যা কাজে লাগিয়ে সামান্য ব্যাটারি রিকশাকে ক্রটি মুক্ত করা যাবে না? আলবৎ যাবে, রাষ্ট্র  সেটা চায় কি-না  সেটাই আসল প্রশ্ন।  এবার আসা যাক বিদ্যুৎ অপচয় প্রসঙ্গ। একটা ব্যাটারি রিকশাকে পুর্ণাঙ্গ চার্জ দিতে ৩ ইউনিট বিদ্যুৎ লাগে, সে হিসেবে ৫০ লক্ষ ব্যাটারি রিকশাকে চার্জ দিতে কত বিদ্যুৎ লাগে? বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নানা সূত্র বলছে, বড়জোর ৫০০ মেগাওয়াট, অথচ দেখুন দেশে বিদ্যুৎ  উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা সংকটের কারণে ৩০ থেকে ৩২ পারসেন্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হয়, তাছাড়া এই অলস বসে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ নামে বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রকে শোধ করতে হয়! সেই বিবেচনায় ব্যাটারি রিকশা বিদ্যুৎ অপচয় নয়, বরং অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা করছে! শুধু তা নয়, ব্যাটারি রিকশা প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনে ২০ টাকা করে, সেই বিবেচনাও যদি বলি, ব্যাটারি রিকশাতে বিদ্যুত দিয়ে সরকার লসে নয়, বরং লাভে থাকে। তারপরেও রাষ্ট্র ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ ব্যাটারি রিকশা আর তার সাথে যুক্ত আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষের পাতের ভাত কেড়ে নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে কেন? (মতামত লেখকের নিজস্ব)
লেখক : সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক কর্মী