সুপ্রভাত ডেস্ক »
প্রভাবমুক্ত ব্যাংক কমিশন করে ব্যাংকের সঠিক চিত্র তুলে আনার মাধ্যমে অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাংক খাতের দুর্বলতা সারিয়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী নেতারা।
তারা বলছেন, বিগত সরকারের সময়ে কয়েকটি পরিবারের হাতে ব্যাংক খাতকে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে এ খাতকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
সোমবার (২৬ আগস্ট) জাতীয় প্রেস ক্লাবে সচেতন ব্যাংকার সমাজ আয়োজিত ‘ব্যাংক খাত সংস্কার: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান বক্তার বক্তব্যে তারা এ কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ইসলামী মূল্যবোধ ধারণ করেন, এমন লোককে ইসলামী ব্যাংকের প্রধান করতে হবে। ব্যতিক্রম হলে মেনে নেওয়া হবে না।
তিনি বলেন, পদের দরকার নেই। কথা বলার সময় এসেছে, যেখানে আছে সেখান থেকেই কথা বলতে হবে। রাস্তায় থেকে আওয়াজ তুললেও জায়গামতো পৌঁছে যাবে, ফল পাওয়া যাবে।
তিনি আরও বলেন, যারা টাকা পাচার করেছেন, তাদের আর দরকার নেই। ঘুষখোর, সুদখোর, টাকা পাচারকারীদের আর দরকার নেই। যদি আইনের শাসন কার্যকর করা যায়, গণতান্ত্রিক মুক্ত পরিবেশ কার্যকর করা যায়, বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। দেশের মানুষও বিনিয়োগ করবে।
বিগত সরকারের সময়ে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফিরিয়ে আনা সহজ হবে না, উল্লেখ করে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শ্রীলঙ্কা পারেনি, পাকিস্তান পারেনি, ঘানা পারেনি, আমরাও পারব বলে আশা করতে পারি না। কারণ যেসব দেশে টাকা চলে যায়, সেসব দেশ টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কথা বলতে চায় না।
অনুষ্ঠানের সভাপতি এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, সরকারের কাছে দাবি তোলার জন্য রাস্তায় চিৎকার না করে লিখিত আকারে বা গণমাধ্যমের মাধ্যমে দাবি জানাতে হবে। আজকের মুক্ত অবস্থার জন্য অনেকে জীবন দিলেন। কী পেলাম বা না পেলাম, এ নিয়ে যেন আক্ষেপ না করি। আমরা কথা বলার মতো একটি মুক্ত পরিবেশ পেয়েছি।
সাবেক অর্থসচিব ইউনুসুর রহমান বলেন. সরকার ব্যাংকিং কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংক কমিশন করার সময় মামলা -মোকদ্দমা হবে। এ জন্য যেন আইন করে উচ্চ আদালতে একটি ভিন্ন বেঞ্চ গঠন করা হয়। তা না হলে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে ব্যাংক কমিশন করার জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব করা হয়েছিল। বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনের পর তা করা হবে। সে সময় যদি কমিশন করা হতো, তাহলে আওয়ামী শাসনের শেষ পাঁচ বছর যে লুটপাট হয়েছে, তা হতো না।
বিগত সরকারের সময়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না বলে উল্লেখ করেন সাবেক আরেক অর্থসচিব এম. আসলাম আলম। তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংকের অবস্থা নিরূপণের জন্য নিরপেক্ষ অডিট প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে অডিট করিয়েছিলাম। অডিটে যে চিত্র উঠে এসেছিল, তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে বলা হয়েছিল। কিন্তু অনুমতি পাওয়া যায়নি। বলা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠাতে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তখন বেসিক ব্যাংক লুটপাটের ব্যবস্থা নিলে পরে আর এ ধরনের লুটের ঘটনা ঘটত না।
ব্যাংক কমিশন গঠন করা অনেক বড় কাজ। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ছেড়ে দেওয়া যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাধীন নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাংকের চিত্র নিরূপণ করে ব্যাংক কমিশনের পথে এগোতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকে যে লুটপাট হয়, সেখানে যারা বোর্ডে থাকেন বা ফোনে হুমকি দেন, নির্দেশ দিয়ে লুটপাট সম্পন্ন করেন, প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের ধরা যায় না। কিন্তু জেল খাটেন ম্যানেজার বা ডিএমডি যারা দায়িত্ব পালন করেন। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি লুটপাট বন্ধ করতে হলে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকা প্রকৃত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুল হক বলেন, ইসলামী ব্যাংক বন্ধ করার জন্য বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। ইসলামী ব্যাংক বন্ধ করার মত আত্মঘাতী উদ্যোগ যেন না নেওয়া হয়, তা নিয়ে সে সময়ের গভর্নর আতিউর রহমানকে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি সেটা বুঝেছিলেন। গভর্নরের নিজের কিছু করার ছিল না। তিনি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। অর্থমন্ত্রীকে বিষয়টিকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম বলে সে ধাক্কায় ইসলামী ব্যাংক ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নকীব নসরুল্লাহ বলেন, এখনকার ব্যাংক খাতের অবস্থার জন্য দায়ী রাষ্ট্রযন্ত্র। রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাত থেকে একটি পরিবারের হাতে চলে গিয়েছিল। তার নির্দেশে সব কিছু হতো। ইসলামী ব্যাংক এখন চলছে একটি সার্কুলার দিয়ে। ব্যাংকিং খাতের ৩০ থেকে ৩৩ ভাগ আবর্তিত হয় ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যম। এখন ইসলামী ব্যাংকের মতো বিশেষ ব্যাংকের জন্য আইন তৈরির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
মূল প্রবন্ধে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুযোগ নিতে সুদখোর, ঘুষখোররা ইসলামী ব্যাংকিং চালু করেছে। তারা নিজে ইসলামী জীবন যাপন করে না, ইসলাম বোঝে না। মানুষের টাকা লুট ও ব্যাংকিং সুবিধা নেওয়ার সুবিধা নেওয়ার জন্য ইসলামী ব্যাংক খুলে বসেছে।
তিনি প্রচলিত ব্যাংকিংয়ে পরিচালক নিয়োগ, সুশাসন ও পরিচালনা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্র্যাক ব্যাংকের নীতি অনুসরণ করার পরামর্শ দেন। তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনীতিতে ৬১টি ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। বিশেষ ধরনের ব্যাংকগুলোকে একীভূত করতে হবে। ২০১৬ সালের পর বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকের কোনো সফলতা নেই। এর পর থেকে ইসলামী ব্যাংকের নামে লুটপাট হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুরায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ সেমিনারে বক্তব্য দেন। সূত্র: বাংলানিউজ।