আবু মোশাররফ রাসেল :
বাঁশগুলোকে প্রথমে ধারালো দা দিয়ে ফালি ফালি করে চিরে নেন তিনি। তারপর সেই ফালিগুলোর বুকে দা চালিয়ে চ্যাপ্টা করেন। সেই চ্যাপ্টা মতো জিনিসগুলো নিয়ে, বিশেষ কায়দায় একটিকে অন্যটির চাপায় দিয়ে তিনি বেড়া তৈরি করছেন। বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি হবে আমাদের ঘর। লোকটি পানি খেতে চেয়েছে বলে মা আমাকে একজগ পানি নিয়ে পাঠিয়েছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তার কাজ দেখি, আমার দিকে তাকানোর সময় তার নেই। আমি তাকে নানুভাই বলে ডাকি। তিনি মাথা তুলে বলেন, ‘ওহ তানজিনা, পানি এনেছো? বেড়া বানানোর সময় খুব সাবধান থাকতে হয়, নয়তো হাত কেটে যায়।’
বর্তমানে আমরা যে বাড়িটিতে আছি, সেটিও বাঁশের বেড়া আর ছনের ছাউনি দিয়ে তৈরি। প্রতিবছর বর্ষায় বৃষ্টিতে ভিজে ছনের ছাউনিটা পচে যায়। বৃষ্টির দিন শেষ হয়ে রোদের দিন এলে বাবা বাজার থেকে ছন কিনে আনেন আর নানুভাই এসে সেগুলো দিয়ে ঘরের ছাউনি নতুনভাবে ঠিকঠাক করে দেন। তিনি আমাদের নানার বাড়ির এলাকার লোক, তাই আমরা নানুভাই বলে ডাকি। এ বছর আমাদের বাড়িটি বাতাসে প্রায়ই ভেঙে গেছে, বেড়াগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। তাই পুরো বাড়িটিই নতুন করে তৈরি করতে হচ্ছে।
পুরোনো বাড়িটির মতো নতুন বাড়িটিও কেন বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি করছে, সেটা আমার মাথায় আসে না। আমাদের একটি পাকা বাড়ি বানাতে পারে না? আমি নানুভাইকে প্রশ্নটি করলাম। তিনি হেসে বললেন, ‘পাকা বাড়ি ভালো নয়, আলো-বাতাস ঢুকে না।’ আমি বললাম, বাঁশের ঘর তো বাতাসে ভেঙে যায়, ছাউনি পচে যায়। তিনি বললেন, তাহলে তোমার বাবার কাছে জিজ্ঞ্যেস করো। আমি বাবার কাছে গেলাম, তাকেও প্রশ্নটি করলাম। বাবা, আমার কথা শোনে একটু আনমনা হলেন। তারপর বললেন, পাকাবাড়ি বানাতে ইট, সিমেন্ট লোহা অনেক কিছু কিনতে হয়। এত টাকা তো আমাদের নেই। এটুকু বলার পর তিনি সম্ভবত বিভ্রান্ত হলেন যে, ছোট মেয়েটাকে এ-কথা বলা ঠিক হয়নি। তাই তিনি পরক্ষণেই বললেন, শোনো মা, পাকাবাড়ি ভালো নয়। আলো-বাতাস ঢুকে না, ভেতরে অন্ধকার থাকে, দেওয়ালের ভেতরে এক রুমের কথা অন্যরুমে শোনা যায় না। আমি এবার মা’র কাছে গেলাম। তাকেও একই প্রশ্ন করলাম। মা একটু হেসে বললেন, তোর কি পাকাবাড়ির খুব শখ? তোর বাবার তো পাকাবাড়ি করার টাকা নেই। আচ্ছা, তোর যখন শখ তোকে পাকাবাড়ি দেখে বিয়ে দেব! মায়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে আমি লজ্জায় লাল হয়ে আর কিছু বলতে পারি না।
নানুভাইসহ আরও কয়েকজন সপ্তাহখানেক কাজ চালিয়ে আমাদের বাড়িটি তৈরি করে ফেললেন। দুই কামরার বাড়ি, এক কামরা মা-বাবার, অন্য কামরায় থাকবো আমরা তিন ভাই বোন। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে, অন্য দুজন আমার ছোটভাই। দুই কামরার মাঝখানে যে বেড়া একটি একপাশ দরজার জন্য খোলা রাখা হয়েছে। তবে দরজা লাগানো হয়নি। বেড়ার ঘরের যে সুবিধার কথা বাবা বলেছিলেন, আসলেই তা ঠিক। ভোরে সূর্য ওঠার সাথে-সাথে আলোয় ঝলমল করে ঘরটি। বেড়ার ফাঁক দিয়ে শোঁ শোঁ করে বাতাস ঢোকে আর বাবা-মা তাদের কামরায় কথা বললে আমাদের কামরায় শোনা যায়। আমরা কথা বললে তারাও শোনেন। রাতে বাবা কাজ থেকে ফিরে একবার আমাদের কামরায় উঁকি দেন। আমরা ঘুমিয়েছি কি-না দেখে মায়ের সাথে নানা ধরনের কথাবার্তা বলেন। আমি মাঝে-মাঝে ঘুম আসতে দেরি হলে সেসব কথা শুনি।
বাবা খুব ভোরে কাজে বের হয়ে যান। ফিরতে-ফিরতে রাত হয়ে যায়। সে কারণে ঘরের প্রায় সব কাজ মা একা করেন এবং ঘরে কি দরকার, কার বিষয়ে কি করতে হবে বা উচিত- সেসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনা তারা ঘুমানোর আগে সারেন। বাবাও সারাদিন কোথায় কী করলেন তা মাকে বলেন। সেসব কথার বেশির ভাগই আমি শুনি।
আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। স্কুলের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আমি কবিতা আবৃত্তিতে দ্বিতীয় হই। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে স্কুল কমিটির সভাপতি জামিল চাচা আমাদের হাতে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন। তিনি হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কার মেয়ে, মা? আমি বাবার নাম বললাম। সম্ভবত, তিনি বাবাকে চিনতে পেরেছেন, তাই আর কিছু জানতে চাননি। তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমাদের অনেক উপদেশ দিলেন। আমরা যেন কম বয়সে বিয়ে বা বাল্যবিয়ে না করি, সে আহ্বান জানালেন।
আমি ঘরে ফিরে জামিল চাচা যে আমার বাবার নাম জানতে চেয়েছেন সে কথা মাকে বলি। কথা শুনে মা আামার সারা শরীরের দিকে ড্যাব-ড্যাব চোখে একবার তাকালেন। তারপর বললেন, কাল থেকে স্কুলে যাওয়ার সময় আমার যে বড় ওড়নাটা আছে সেটি গায়ে জড়িয়ে যাবি। জামিল চাচা, আমার পরিচয় জানতে চেয়েছেন তার সাথে বড় ওড়না পরার কি সম্পর্ক আমি কিছুতেই ভেবে পাই না। ভয়ে মাকেও আর প্রশ্ন করি না। কারণ, অযথা প্রশ্ন করলে মা খুব বিরক্ত হন। বলেছেন, মা-বাবা যা করেন সন্তানের ভালোর জন্যই করেন, সবকিছু বুঝার চেষ্টা করবি না।
এর কয়েকদিন পর বাবা ঘুমানোর আগে মাকে বললেন, শুনছো তানজিনার মা? মেয়ের জন্য তো একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ওদের স্কুলের সভাপতি জামিল ভাই খুব করে বলেছেন। ভালো ছেলে, ছেলেটা নাকি মাস্কাট থাকে। মা বললেন, মেয়েটার কি বিয়ের বয়স হয়েছে? বাবা গলাটা আরেকটু বাড়িয়ে বলেন, ‘বিয়ের বয়স-টয়স আবার কী? যা দিনকাল পড়ছে, মেয়ে বেশিদিন ঘরে রাখা ঠিক হবে না। তাছাড়া ছেলে বিদেশে অনেক টাকা কামাই করে। মা গলা নিচু করে বললেন, ওদের বাড়িঘর কেমন জেনেছো? মেয়েটার তো আবার পাকবাড়ির শখ? বাবা বললেন, বাড়ি এখনও পুরোনো বেড়ার ঘর। তবে ছেলেটা বিদেশ থেকে এলেই পাকাঘর বানাবে। জামিল ভাই আমাকে কথা দিয়েছেন, আমাদের তেমন খরচও করতে হবে না। সব ছেলেপক্ষ করবে। এমন সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। মা নীরব হয়ে গেলেন। আমার মনে পড়লÑবাংলা বইয়ে প্রবাদ আছে, ‘মৌনতা সম্মতির লক্ষণ’।
আমার মতামত কিংবা সম্মতি কোনোটিরই প্রয়োজন মনে করলেন না বাবা-মা কিংবা ছেলেপক্ষের কেউই। শীঘ্রই ঘনিয়ে এলো শুভদিন। প্রবাসী বরের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল।
আমার শ^শুরবাড়িটিও বেড়ার তৈরি। সে কারণে এক কামরায় কেউ কথা বললে অন্য কামরায় শোনা যায়। বিয়ের প্রথম রাতে আমার বর রেজাউল ফিসফিস করে বলল, ‘বিদেশে আমি উঁচু দালানে থাকি, এখানে বেড়ার ঘরে থাকতে ভালো লাগে না। এবার আমি বিদেশে গেলে আরেকবার দেশে আসার আগেই টাকা পাঠিয়ে পাকাবাড়ি বানাবো।’ কথা শুনে বেশ খুশি লাগলো আমার।
স্কুলের ছাত্রী থেকে হঠাৎ শ^শুরবাড়ির বউ হয়ে যাওয়া আমার জীবনটা কেমন যেন বদলে যেতে থাকলো। ভোরে ঘুম থেকে ওঠে যে আমি বই নিয়ে বসতাম, অংক কষতাম, মায়ের রান্না করা খাবার খেয়ে-দেয়ে ড্রেস পরে স্কুলের পথ ধরতাম, সেই আমার জীবনের রুটিনটি ভিন্ন হয়ে গেল। শাশুড়ি মা ভোরে ডেকে তুলেন। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে সবার জন্য খাবার রান্না করতে বলেন। আবার সেসব সবাইকে পরিবেশন করার দায়িত্বও আমার কাঁধে। প্রথম দিকে রেজাউলকে খুব ‘ভালো ছেলে’ মনে হতো, দিন যতই যায় তার আচরণও বদলাতে থাকে। তবে একটা সুবিধা আছে, রেজাউল আমার ওপর কোনো বিষয়ে রাগ দেখালে কিংবা বকাঝকা করলে শাশুড়ি মা দৌড়ে এসে আমার পক্ষ নেন।
বিয়ের একমাস পর রেজাউল আবারও বিদেশে পাড়ি জমাল। এর কিছুদিনের মধ্যেই টাকা পাঠিয়ে আমার শ^শুরকে বলল, পাকাবাড়ি তৈরির কাজ শুরু করতে। আমার শ^শুর ইট, সিমেন্ট, লোহা কিনে আনলেন। তারপর মিস্ত্রি আনা হলো। মিস্ত্রিরা ইটের ওপর ইট বসিয়ে পাকাবাড়ি বানাতে লাগলো। আমার তখন নানুভাইয়ের কথা মনে পড়ল, বাঁশ হোক আর ইট হোক কাজের কায়দাটি একই।
একদিন শুক্রবার। মসজিদে শিরনি দিয়ে মুসল্লিদের মিষ্টিমুখ করিয়ে আমরা পাকাবাড়িতে উঠে গেলাম। বাবা-মা আমাকে দেখতে এসে, আমার কামরা দেখে দারুণ খুশি হলেন। মা বললেন, তোর পাকাবাড়ির শখ তো মিটল রে তানজিনা। আমি একটি তৃপ্তির হাসি দেই। শ^শুরবাড়ির হাজার কাজ, সবার মন জুগিয়ে চলা অনেক কঠিন। তবুও জীবনটাকে বড়ই সুন্দর মনে হতে লাগলো আমার।
বছর খানেক পর রেজাউল এল দেশে। এর সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেখলাম তিনি ‘অন্যমানুষ’ হয়ে গেছেন! কথায় কথায় আমার দোষ ধরা শুরু করলেন তিনি। মাঝে-মাঝে নানা ধরনের মিথ্যা অপবাদ দেন। আমি কিছু বলতে গেলে চোখ রাঙান। ধমকের সুরে কথা বলেন। তার ধমক চার দেয়াল ভেদ করে আমার শাশুড়ির কানে পৌঁছায় না। তিনি শুনলে নিশ্চয় দৌড়ে এসে আমার পক্ষ নিতেন। আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি অদ্ভুতভাবে বদলে গেছেন। কথায়-কথায় সন্দেহ, অবিশ^াস। আর বলছে, আমি নাকি তার অনুপস্থিতিতে খালাতো ভাইয়ের সাথে ‘প্রেম করি’। বিয়ের পর থেকে শ^শুরবাড়িতে আমার ওপর এত কাজের চাপ যে, তার সাথেই কথা বলার সময় পাইনি ভালোভাবে। আর বলে কি-না খালাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম! আমি ভেবে পাই না এসব কী ঘটছে। ধৈর্য রাখলাম। নীরবে-নিভৃতে তার অত্যাচার-নির্যাতন সয়ে-সয়ে দিন কাটাতে লাগলাম।
এভাবে আরও কিছুদিন যেতে পারত। কিন্তু ততক্ষণে হয়তো জীবনের বিনিময়ে ধৈর্যের দাম দিতে হতো। একদিন বাবা-মাকে ডেকে আনা হলো, সালিশ হলো। অপবাদের সাগরে ভাসানো হলো এবং আমার গায়ে অনেক কলঙ্ক জুড়ে দিয়ে রেজাউল তার জীবন থেকে আমাকে বিদায় করে দিল।
জীবনটাকে বেড়ার ঘরের ছনের ছাউনির মতো মনে হতে থাকল আমার। প্রতি বছর বর্ষায় বৃষ্টিতে ভিজে ছনের ছাউনি পচে যায়, আমারও যেন তাই হলোÑআমার জীবনের ছাউনিটি দ্রুতই পচে গেছে।