রেবা হাবিব »
পান্থপথের ঠিক মাঝামাঝি একটা সিগন্যাল আছে। প্রতিদিন সকালে, দুপুরে, রাতে লাল বাতি জ্বললেই ফুটপাত থেকে হেঁটে আসে এক মোটা লোক। মাথায় লাল ফেটে যাওয়া টুপি, হাতে এক গোছা রঙিন বেলুন। লোকটার নাম লোকজন কেউ ঠিক জানে না। তবে আশেপাশের দোকানদার, রিকশাওয়ালা, বাসচালক সবাই ডাকে ‘বেলুনকাকা’।
বেলুনকাকার গায়ের রঙ পাকা তেঁতুলের মতো গাঢ়, বয়স আন্দাজ করলে পঞ্চাশের কাছাকাছি। শরীর গোলগাল, কিন্তু হাঁটার ভঙ্গি অদ্ভুত তেজি যেন প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে লাফ দিয়ে উঠছে তার বেলুনগুলো।
তার বেলুন বিক্রির ধরনও আলাদা। কেউ দাম জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘এই বেলুন কিনলে হাসি ফ্রি!’
আর বলে নিজেই হো হো করে হেসে ওঠেন।
বেলুনকাকা একসময় বাস ড্রাইভার ছিলেন। নাম ছিল ফারুক। দুর্ঘটনায় এক চোখে ক্ষীণ দৃষ্টি চলে যাওয়ার পর চাকরি গেল। স্ত্রী-সন্তান তখন গ্রামের বাড়ি চলে গেল, আর তিনি শহরে থেকে গেলেন। সেই থেকে বেলুন বেচা শুরু।
ফারুকের কাছে এই বেলুন বিক্রি কোনো বেঁচে থাকার উপায় মাত্র না। এ যেন তার নিজের উৎসব। প্রতিটা বেলুনে তিনি দড়ি বাঁধার আগে ফুঁ দিয়ে বলেন, ‘তুই হাসি নিয়ে যাস।’
কে শুনছে, কে শুনছে না তা তার মাথাব্যথা না। পান্থপথের আশেপাশের সবাই জানে, বেলুনকাকার সঙ্গে থাকে একটা ছোট মেয়ে সোনাই। বয়স এগারো। কপালে ছোট্ট সিঁদুরের দাগের মতো জন্মদাগ। গায়ের রঙ চাপা শ্যামলা, চোখদুটো সবসময় খোলা বিস্ময়ে ভরা।
সোনাইকে একদিন কাকার সঙ্গেই দেখা যায়। পরে লোকজন জানতে পারে, ছোট্ট মেয়েটা একসময় ফুটপাতে ভিক্ষা করত। বেলুনকাকা এক সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে চলে আসেন নিজের খুপরি ঘরে। খাবার, কাপড়, স্কুল সব দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে।
সোনাই স্কুলে পড়ে, কিন্তু বিকেলে কাকার সঙ্গে বেরোয়। বেলুন ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘দেখবি, তোকে দেখেই বেলুন কিনতে আসবে লোকজন। তুই হাসিস, বাকিটা আমি সামলাব।’
বেলুনকাকার কাছে নিয়ম ছিল, যে শিশু এসে বলে ‘আমার কাছে টাকা নেই’ তাকে একটা বেলুন ফ্রি দিতে হবে।
‘বেলুন কেবল টাকায় কেনা জিনিস না, বুঝলি?’ বলেন কাকা ‘বেলুন মানে হাওয়া, আর হাওয়ার দাম কেউ রাখে না।’
সোনাই একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি ফ্রি দিলে তো তোমার ক্ষতি হয় না?’
কাকা হেসে বলেছিলেন, ‘হাসির ব্যবসায় লাভ-ক্ষতি হয় না রে সোনা।’
এক বিকেলে, সিগন্যাল লাল হতেই কাকা আর সোনাই ফুটপাত থেকে রাস্তায় নেমে এল। এক মহিলা বাসের ভেতর থেকে নেমে বললেন, ‘আমার মেয়ের জন্মদিন আজ। দশটা বেলুন দেবেন?’
কাকা বেলুন দিচ্ছিলেন, হঠাৎ দেখলেন সোনাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে, ঠোঁট কামড়ে আছে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে?’
সোনাই ফিসফিস করে বলল, ‘আমারও তো কাল জন্মদিন’
কাকা এক মুহূর্ত থমকালেন, তারপর বেলুনগুলো মহিলার হাতে দিয়ে নিজের পকেট থেকে একটা নীল বেলুন বের করলেন। সোনাইয়ের হাতে দিয়ে বললেন, ‘তোর জন্মদিন আগে শুরু হোক।’
সেদিন রাতে, কাকা ভাতের সঙ্গে শুধু ডাল খেলেন, কিন্তু সোনাইয়ের জন্য আনলেন গরম জিলাপি। বললেন, ‘আমার জন্মদিনও আজ থেকে এই তারিখেই। কারণ এই দিনে আমার সংসারে তুই ঢুকেছিস।’
দুই বছর পর, বেলুনকাকা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তারের পরামর্শে আর রোদে দাঁড়িয়ে বেলুন বেচা সম্ভব হলো না। সোনাই তখন ক্লাস সেভেনে, কিন্তু নিজের হাতে কাকার বেলুনের গোছা ধরে দাঁড়াল সিগন্যালের মোড়ে। লোকজন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কাকা কোথায়?’
সোনাই হাসল, ‘ওই তো বাসায়ৃ কিন্তু হাসির ব্যবসা বন্ধ হবে কেন?’
এখন পান্থপথের মানুষ জানে, ফারুক কাকা নেই রাস্তায়, কিন্তু সোনাই আছে। তার বেলুন কিনলে এখনো হাসি ফ্রি পাওয়া যায়। আর ফারুক কাকার খুপরি ঘরে দেয়ালে টাঙানো আছে একটা নীল বেলুন, যেটা এখনো ফুসফুসের মতো ফুলে আছে, হয়তো কোনোদিন হাওয়া ফুরোবে না।