হুমাইরা তাজরিন »
প্রতিটি মানুষেরই আছে অপরের ক্ষতি না করে স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার। কিন্তু মানব সভ্যতার এমনও অনেক যুগ কেটেছে যেখানে মানুষের স্বাধীনতা চূড়ান্তভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। মানুষ পরিণত হয়েছে অন্যের দাসে। ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৮ সাল থেকে প্রতিবছর আজকের দিনে (২৩ আগস্ট) আর্ন্তজাতিকভাবে দাস বাণিজ্য স্মরণ ও রদ দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১৭৯১ সালের ২২ থেকে ২৩ আগস্ট রাতে হাইতি প্রজাতন্ত্রের সেন্ট ডোমিংয়ে এই প্রথার রিুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিলো। এই বিদ্রোহ ট্রান্স আটলান্টিক ক্রীতদাস বাণিজ্যের বিলুপ্তিতে গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিবছর আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালন করা হয়। প্রথমে এটি ১৯৯৮ সালের ২৩ আগস্ট হাইতিতে এবং ১৯৯৯ সালের ২৩ আগস্ট সেনেগালের গোরি দ্বীপে উদযাপিত হয়েছিলো।
এই আন্তর্জাতিক দিবসটি মানুষকে বিশ্বব্যাপী দাসপ্রথার ট্র্যাজেডি সম্পর্কে জানাতে এবং সচেতন করতে পালিত হয়। শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণ-নিপীড়ন, মানবপাচার, জোরপূর্বক বিয়ে ও ধর্ষণ, যৌনদাসত্ব, এবং যুদ্ধে শিশুদের ব্যবহার রোধে সচেতনতা বাড়ানোই এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য।
মানবসভ্যতার ইতিহাস হতে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ অব্দে মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ক্রীতদাস প্রথা চালু হয়। যা ১ হাজার বছরের মধ্যে মিশর হয়ে ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। কলম্বাস যখন আমেরিকা আবিষ্কার করলেন সদ্য আবিষ্কৃত মহাদেশে ইউরোপিয়ানরা ছুটে আসেন। তবে এতো অনাবাদি জমি আবাদ করার মতো দক্ষ জনবল তাদের ছিল না। তাই আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে আফ্রিকা থেকে এইসব অনাবাদি জমি চাষ করার জন্য দাস আনা হতো। যাকে বলা হয়েছে ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড। ১৮৬১ সালে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিনি প্রায় ১০ হাজারের মতো দাসকে মুক্ত করেছিলেন। এজন্য দাসপ্রথা বিলুপ্তিতে আব্রাহাম লিংকনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
অপরদিকে ভারতীয় উপমহাদেশেও দাসপ্রথা ছড়িয়ে পড়েছিলো বাংলার সুলতানরা আফ্রিকা ,তুরস্ক ,পারস্য ও চীনদেশ হতে দাস-দাসী আমদানি করতো বলে জানা যায়। বাংলার বাজারে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত আফ্রিকান ‘হাবশী’ ও ‘কাফ্রি’ নামে ক্রীতদাস আমদানি করা হতো। মুসলমান সমাজে পুরুষ দাসদের বলা হতো গোলাম বা নফর এবং দাসীদের বলা হতো বান্দি বা লৌন্ডি। হিন্দু ও মুসলিম উভয় আইনে, দাসীরা যৌনদাসত্বেও বাধ্য থাকতো। উনিশ শতকের প্রথম দিকে বৃদ্ধ ও শিশু দাসদের বাজার দর ছিল ৫ থেকে ৭ টাকা। স্বাস্থ্যবান তরুণ দাসদের বাজার দর ছিল ২০ থেকে ৫০ টাকা। দাস প্রথার অধীনে থাকা শ্রমিক ব্যবস্থা শিল্পায়ন ও শিল্প-বিপ্লবোদ্ভূত নতুন মানবিক মূল্যবোধের সাথে সংগতির্পূণ না হওয়ার ফলে আঠারো শতকের শেষ দিকে ইউরোপে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাস প্রথার বিলোপ ঘটে। তাই ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন সরকার দাসপ্রথাকে বিলুপ্ত করার জন্য কলকাতা সরকারকে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়। ধাপে ধাপে দাসপ্রথা বিলুপ্তির জন্য ‘অ্যাক্ট ফাইভ’ প্রনীত হয়। এর ফলে শুরুতে দাসের সাথে মুক্ত ব্যক্তির আইনগত পার্থক্য ঘুচেছিল। দাসপ্রথাকে সামাজিকভাকে ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য হিসেবে পরিগণিত করতে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মানবতাবাদী আন্দোলনগুলো অগ্রনী ভূমিকা পালন করে এবং বিশ শতকের গোঁড়ায় বাংলা দাসপ্রথা মুক্ত হয়। তবে দাস প্রথার বিলোপ ঘটলেও এখনও ওয়ার্ল্ড লেবার অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ জোরপূর্বক শ্রম, দাসত্ব ও দাসত্ব সংশ্লিষ্ট প্রথার কাছে বন্দি রয়েছে।