মো. সিরাজুল মোস্তাফা »
মেধা ও অধ্যাপনায় যে মানুষটি বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের চিকিৎসা জগতকে আলোকিত করেছেন তিনি চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম। উপমহাদেশের মানবদরদী কৃতী চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম ১৯২৮ এর ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের চন্দনাইশের মোহাম্মদপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দুর রহমান, মাতা রতœগর্ভা গুলমেহের বেগম। ৩ ভাই ৫ বোনের মধ্যে সবার ছোট নুরুল ইসলাম। তাঁর বয়স যখন মাত্র চার তখন তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। অল্প বয়সে পিতৃহারা হয়ে মা ও বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে তিনি বেড়ে উঠেন। মা গুলমেহের তাঁর জীবনে অপরিমেয় প্রভাব রাখেন। ১৯৪৩ এ গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে লেটার সহ মেট্রিক পাস করেন এবং সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। কোলকাতার ঐতিহাসিক ইসলামিয়া কলেজ হতে ১৯৪৫ সালে কৃতিত্বের সাথে আই.এস.সি পাস করে কলিকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৫০ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে এমবিবিএস পরীক্ষায় পাস করেন। ছয় মাস প্রশিক্ষণের পর ১৯৫১ সালে কৃতিত্বের সাথে এমবিবিএস ডিগ্রি সনদ লাভ করেন।
১৯৫৪ সালে লন্ডনের হুইটিং ইন হাসপাতাল হতে এফআরসিপি ডিগ্রি লাভ করে পূর্ব পাকিস্তানে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ১৯৫৫ সালে ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় হতে টিডিডি ডিগ্রি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি চিকিৎসা জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ওয়েলস হতে টিডিডি পরীক্ষায় কৃতিত্ব দেখিয়ে মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে এডিনবরা হতে ১৯৫৬ সালে এমআরসিপি ডিগ্রি লাভের পর তিনি দেশে ফিরে ঢাকাস্থ মেডিকেল স্কুল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে যোগ দেন।
১৯৬১ এর শেষের দিকে তিনি প্রফেসর অব মেডিসিন হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে যোগ দেন। তিনি ২৬ ডিসেম্বর ১৯৬২ সালে আনোয়ারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে চিকিৎসা শাস্ত্রে নাফিল্ড ফেলোশিপ নিয়ে ডিজিটির প্রফেসর হিসেবে যোগ দিতে লন্ডন যান। ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আই.পি.জি.এম আর (পিজি হাসপাতাল) প্রতিষ্ঠায় তিনি হলেন অন্যতম উদ্যোক্তা। প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি পিজি হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক, পরবর্তীতে পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। পিজিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রথিতযশা চিকিৎসক হিসেবে তিনি তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে সমাদৃত হন।
১৯৭২ হতে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকান্ড- পর্যন্ত ডা. নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এ ভালবাসা ও অগাধ বিশ্বাসের মর্যাদা তিনি রেখেছেন। পিজির পরিচালক পদে থাকাকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক মানের কয়েক শত গবেষণা নিবন্ধ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৭ এর ৩১ মার্চ সরকার ডা. নুরুল ইসলামকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন।
১৯৮৫ তে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে ভারতের গোল্ডেন গ্রাহক সেবা পদক, পাকিস্তানের মদিনাতুল হিকমাতর ও সেফা-ই-আতরাফ, মহাত্মা গান্ধী অহিংস শান্তি পুরস্কার, চিকিৎসা শাস্ত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ভারতের বিসি রায় পদক ২০০৩, বাংলাদেশ সরকারের সমাজ সেবা পদক ১৯৯৯, ¯œাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষা প্রসারে তাঁকে বিশেষভাবে সন্মানিত করা হয়।
তিনি ১৯৫৮ সালে জাতীয় যক্ষèা সমিকি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৮ সালে জাতীয় ঔষধ নীতি প্রণয়ন করেন। বাংলাদেশের এ ঔষধনীতি একটি শক্তিশালী জনকল্যাণমুখী ঔষধনীতি হিসেবে দেশ বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। তাঁর প্রণীত এ ঔষধ নীতি বাস্তবায়নের ফলে দেশীয় ঔষধ শিল্প বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যার ফলে দেশের ঔষধ শিল্প সমৃদ্ধ হয়। তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদকসহ দেশ বিদেশের বহু পদকে ভূষিত হয়েছেন। বিশ্বনন্দিত আধুনিক (আমরা ধূমপান নিবারণ করি) এর তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বিশ্বের সবগুলো ধূমপান বিরোধী মহাসম্মেলনে তিনি আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে যোগ দেন এবং ধূমপান মুক্ত সমাজ গঠনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের শতাধিক নিবন্ধ রচনা ছাড়া ও তিনি ধূমপান বিরোধী একশতের মত প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তিনি প্রায় ২৫ টির মতো পুস্তক রচনা করেছেন। তাঁর পুস্তকগুলোর মধ্যে কয়েকটি মেডিকেল কলেজ সমূহে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাঠ্য পুস্তক হিসেবে পঠিত।
আন্তর্জাতিক চিকিৎসা বিজ্ঞানী, কালজয়ী ও মেধাবী চিকিৎসক চট্টগ্রামের কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক নুরুল ইসলামের চরিত্রের সততা, নির্লোভ, আপোষহীন এবং অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব তাঁকে দিয়েছে বিশেষ স্বাতন্ত্র। দেশে বিদেশে চিকিৎসা জগতের জীবন্ত কিংবদন্তী হিসেবে ডা. নুরুল ইসলামকে চিহ্নিত করা হয়। চট্টগ্রামকে তিনি ভালবাসেন এবং ভালবাসেন তাঁর জন্মভূমিকে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে তিনি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। প্রখর মেধাবী ও চট্টগ্রামের মানুষের আপনজন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ২৪ জানুয়ারি ২০১৩ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসভবন ‘গুলমেহের’ এ অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুত তাঁকে ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯.৪৫ মিনিটে তিনি দেশবাসীকে শোকের সাগরে নিমজ্জিত করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ক্ষণজন্মা এ মহাপুরুষের মৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য এবং চিকিৎসা জগতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
লেখক : অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক
পিপলস্ ইন্সুরেন্স কোং লি.