পাথরের খোয়ার ওপর কাঠের স্লিপার। তার ওপর বসানো রেললাইনের পাত। রেললাইনের ওপর একটি ট্রলি। থেমে আছে। ট্রলির কাঠের কাঠামোটি গুলিতে ঝাঁঝরা। পেছনেই চিথলিয়া রেলওয়ে স্টেশনের সাইনবোর্ড। সেটির বুকেও গুলির চিহ্ন। দেয়ালজুড়ে আলোকচিত্রে বিধ্বস্ত রেলসেতু, দিগন্তরেখায় গিয়ে মেশা ফসলের মাঠ আর গাছগাছালির সবুজ।
যুদ্ধদিনের মুহূর্তটি যেন স্থির হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ৪ নম্বর গ্যালারিতে। এই ট্রলি ৪৬ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ফেনী-বিলোনিয়া রণাঙ্গনের স্মারক। এই যুদ্ধ সামরিক মানদ-ে অনন্য। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিসহ বিশ্বের বহু সামরিক কলেজে পাঠ্য বিলোনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ বা ‘সেকেন্ড ব্যাটল অব বিলোনিয়া বাল্জ’।
২০১৬ সালের শেষ দিকে রেলওয়ের কাছ থেকে ট্রলিটি সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। এর গায়ে বুলেট আর রক্তে আঁকা স্বাধীনতাযুদ্ধের এক জয়ের ইতিহাস। ৬ নভেম্বর, ১৯৭১, ফেনী-বিলোনিয়া রেলসড়ক ধরে এই ট্রলিতেই চার জওয়ানকে নিয়ে চিথলিয়ার দিকে আসছিল এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন। পরিখায় থাকা মুক্তিযোদ্ধা এয়ার আহমেদ ও সঙ্গীদের নাগালের মধ্যে ট্রলিটি আসতেই গর্জে ওঠে হালকা মেশিন গান। সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয় ওই পাঁচ পাকিস্তানি শত্রু। বিলোনিয়াকে মুক্ত করার যুদ্ধে প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয় মুক্তিবাহিনীর।
বিলোনিয়া বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে ফেনী জেলার উত্তরে আন্তর্জাতিক সীমারেখা পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অঞ্চল, যা ফাঁপা আকার (বাল্জ) নিয়ে ঢুকে গেছে ভারতের মধ্যে। উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যবেষ্টিত বিলোনিয়া বাল্জ (ফুলগাজী ও পরশুরাম থানার অংশ) লম্বায় ২০-২৫ কিলোমিটার এবং আড়াআড়ি ৫-৭ কিলোমিটার। অঞ্চলটি মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের ২ নম্বর সেক্টরের অধীন ছিল। সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ১০তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম বীর বিক্রম।
জাফর ইমামের লেখা বই দাম দিয়ে কিনেছি এই বাংলা এবং পাইওনিয়ার প্লাটুনের বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মুস্তাফা সম্পাদিত বই ফেনী-বিলোনিয়া : রণাঙ্গনের এক প্রান্তর বলে দেয় বিলোনিয়া যুদ্ধের ইতিবৃত্ত।
এই যুদ্ধ হয়েছিল দুই পর্বে। প্রথমে প্রতিরোধযুদ্ধ, ২১ জুন পর্যন্ত। পাকিস্তানের ১৫ বেলুচ রেজিমেন্ট, ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধটা এককভাবে মুক্তিবাহিনীই লড়েছিল। দ্বিতীয় যুদ্ধে সাহায্য করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশন। অনুপ্রবেশ (ইনফিলট্রেশন), প্রতিরোধ (ডিফেন্স) ও শেষে সর্বাত্মক আক্রমণ (অ্যাসল্ট) এই ছিল দ্বিতীয় বিলোনিয়া যুদ্ধের রণপরিকল্পনা। মুক্তিবাহিনীর টাস্কফোর্স কমান্ডার ছিলেন প্রথম যুদ্ধের অধিনায়ক ফেনীর সন্তান ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম (পরবর্তীকালে লে. কর্নেল ও বীর বিক্রম), সহ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল, বীর বিক্রম)। ৩ নম্বর সেক্টরের অন্যতম সাব-সেক্টর কমান্ডার হেলাল মোর্শেদকে পরে ডেকে আনা হয় এই যুদ্ধে।
পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয়ে মুক্ত হয় বিলোনিয়া। এরই ধারাবাহিকতায় ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় ফেনী শহর। হেলাল মোর্শেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, বিলোনিয়া দ্বিতীয় যুদ্ধের আসল মাহাত্ম্য অনুপ্রবেশ-যুদ্ধের সাফল্যে। প্রথাবিরুদ্ধভাবে এত বিপুলসংখ্যক মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ ও সফল অনুপ্রবেশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আর ঘটেনি।
৫ নভেম্বর শীতের রাতটিতে বৃষ্টি হচ্ছিল মুষলধারে। কনকনে ঠান্ডা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মধ্যেই সীমান্ত থেকে রণাঙ্গনে চলে আসে মুক্তিবাহিনী। সেকেন্ড লে. মিজানের নেতৃত্বে প্রথমে ঢুকে পড়ে ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের ব্রাভো কোম্পানি, পরে সেকেন্ড লে. দিদারের নেতৃত্বে চার্লি কোম্পানি। একেবারে পেছনে হেলাল মোর্শেদের ২য় ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানি।
পাকিস্তানি অবস্থানের ফাঁকা জায়গাগুলো দিয়ে মুহুরী নদী পেরিয়ে দলগুলো নীরবে এগিয়ে আসে সলিয়ার দিকে। মেজর জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের অধীন ১ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন মাহফুজ তাঁর কোম্পানি নিয়ে গুথুমা দিয়ে ঢুকে ব্রাভো কোম্পানির সামনের অংশের সঙ্গে সংযোগ ঘটান। লে. ইমাম-উজ-জামানের নেতৃত্বে ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের আলফা কোম্পানি মুহুরীর পূর্বপাড়ের ধনিকু-ায় এসে পড়ে। বিরামহীন বর্ষণের রাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়া পাকিস্তানি সেনারা নিজেদের পরিখা ছেড়ে বেরোয়নি। মাঝরাতেই মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের অবস্থানে পৌঁছে ভোরের আগেই খুঁড়ে ফেলে পরিখা। তারপর পরিখায় যুদ্ধের অপেক্ষা।
৬ নভেম্বর, কমে আসা বৃষ্টির মধ্যে ভোরের রাঙা আলোয় অনেকের ক্লান্ত চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। এমন সময়, রেলসড়কে ট্রেন চলার মতো শব্দ। ওটা ওই রেলট্রলি, এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন চার জওয়ানকে নিয়ে বেরিয়েছেন মুক্তিবাহিনীর অবস্থানগুলোর খোঁজে। কিন্তু শ খানেক গজ দূরে থাকা মুক্তিযোদ্ধা নায়েব সুবেদার এয়ার আহমেদ (পরে বীর বিক্রম) ও সঙ্গীদের এলএমজির গুলিতে ওখানেই তাদের শেষ। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান কণ্ঠে উল্লসিত মুক্তিবাহিনী। তবে এয়ার আহমেদের মৃত্যু খানিক পরই ডেকে আনে বিষাদ। জাফর ইমামের বই থেকে জানা যায়, দুঃসাহসী এয়ার আহমেদ ওই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের ব্যাজ এবং ট্রলির অস্ত্রগুলো আনতে ছুটে গিয়েছিলেন। শত্রুর গুলি তাঁকে ফিরতে দেয়নি। ৬ নভেম্বর রাতভর ছোট ছোট আক্রমণ করে পাকিস্তানিরা। ৭ নভেম্বর মর্টার ও কামানের গোলায় আরও তীব্র হয় আক্রমণ। শত্রুপক্ষের চারটি এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান (স্যাবর জেট) সব এলাকা ঘুরে ঘুরে নিচু হয়ে মেশিনগান ও রকেট হামলা চালাচ্ছিল। একটিতে হাবিলদার হাশমতের ভারী মেশিনগানের গুলি লেগে ধোঁয়া বেরোতে থাকে। বিমানটি পরে কুমিল্লার লাকসাম এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। এতেই থামে শত্রুর বিমান হামলা।
ওই রাতেই অবশ্য ভয়ংকরতম আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানিরা। ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীও জবাব দিতে থাকে। একসময় প্রায় মুখোমুখি লড়াই হয়। জীবন বাজি রেখে দক্ষিণে ফুলগাজীর দিকে পাকিস্তানিদের হটিয়ে দেয় মুক্তিবাহিনী। বিপর্যস্ত শত্রুবাহিনীকে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের ব্রিগেডিয়ার সান্ধুর ৩য় ডোগরা রেজিমেন্ট। দুই ঘণ্টার মধ্যেই পরশুরাম দখল। হতাহত শ দেড়েক পাকিস্তানি। ১০ নভেম্বর দুই অফিসারসহ ৭২ জন পাকিস্তানি সৈন্য টাস্কফোর্স কমান্ডারের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। জাফর ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, এটি এককভাবে মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের একমাত্র ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে থেমে থাকা ট্রলিটি ওই যুদ্ধজয়ের কথা বলে। ট্রলিটি বাঙালির গৌরবদীপ্ত ইতিহাস হয়ে থামিয়ে রেখেছে কালের চিরচঞ্চল গতি।
সূত্র : প্রথম আলো। ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭