মো. আবু মনসুর, ফটিকছড়ি
হালদার পাদদেশ থেকে নেমে আসা একসময়ের খরস্রোতা ‘মরা খাল’ নাজিরহাটের বুক চিরে বয়ে গেছে। এ খাল ফটিকছড়ি এবং নাজিরহাটকে দুই ভাগে ভাগ করে মাদ্রাসা, বিদ্যালয়, ঝংকার, ডাইনজুরী, পূর্ব-ফরহাদাবাদ ও দক্ষিণ ধুরুং মৌজা ঘেঁষে কয়েকটি গ্রাম ভেদ করে প্রবাহিত হয়েছে। অন্তত তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এটি একটি শাখা খালে গিয়ে মিশেছে।
খালের নাজিরহাটের মধ্যখান থেকে পূর্বদিকে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে দখল করে গড়ে উঠেছে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা। এর কোনটি বসতঘর আবার কোনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি বাজার এবং ঝংকারের আশেপাশে প্রতিনিয়ত অপরিকল্পিতভাবে অবাধে খালটি ভরাট করে বিলীন করা হচ্ছে।
বিভিন্ন কাগজপত্র পর্যালোচনা করে বুঝা যায়, আরএস, বিএস খতিয়ান ও সিট মুলে এটি রেকর্ডীয় খাল। ভূমির শ্রেণিও দেখানো হয়েছে খালে। দৈর্ঘ্য প্রায় তিন কিলোমিটার। নাজিরহাট থেকে শুরু হয়ে খালের শেষ হয় ডাইনজুরীর পূর্বপার্শ্বে একটি শাখা খালে গিয়ে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আইয়ুব, আবছার, এয়াকুব ও মো. মানিক জানান, একসময় খালের পানির উপর নির্ভর করে আশেপাশের জমিগুলোতে ব্যাপক চাষাবাদ হতো। অনেকে মাছ ধরেও জীবিকা নির্বাহ করতো। এসব আজ কেবলই অতীত। খালটি দখল আর ভরাটের ফলে এটি এখন নিশ্চিহ্ন। তারা বলেন, গোল মো. তালুকদার বাড়ি মসজিদের সামনে দখল করে একাধিক কলোনি, মফিজ সাইকেল গ্যারেজের পাশে, নেজাম বোর্ডিং এর পেছনে, ঝংকার মোড় অংশে বিভিন্ন স্থাপনা, জাগির হোটেলের সামনে বিল্ডিংয়ের পেছনে দখল, পাবলিক শৌচাগার নির্মাণ, বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ সর্বোপরী মাদ্রাসা ও বিদ্যালয়ের নাম করে প্রভাবশালীরা দখল করায় খালটি এখন বিলীনের পথে।
সরেজমিনে দেখাযায়, এখন আর সেই জৌলুস নেই। দখল আর ভরাটে খালটি নিজস্বতা হারিয়েছে। ঝংকারের কাছে বাস করেন আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, মনে আছে এ জায়গাটি খালের। কিন্তু থাকার জায়গা নেই বলে এখানে ঝুঁপড়িতে থাকি। তার পাশে বসবাস করেন ইনজামামুল। তার স্ত্রী নুর জাহান বলেন, ‘ঘর নেই, তাই ঘর করে বসবাস করছি। বিনিময়ে মাসিক টাকা দেই।’
ঝংকারের মোড়ে নাম সর্বস্ব দোকান তৈরী করেছেন মো. দিদার। তিনি অবশ্য দাবি করেছেন, ‘এ সম্পত্তি খালের নয়, তার পিতার কেনা। তবে তিনি বৈধ কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেন নি।’
স্থানীয়রা জানান, প্রথমে খালের বিভিন্ন অংশে মাটি ফেলে ভরাট করা হয়। পরে সেখানে নির্মাণ করা হয় বিভিন্ন স্থাপনা। এলাকাবাসীর মতে, প্রভাবশালীরাই এসব কাজে জড়িত। তারা প্রশাসনের কোন বাঁধা না পেয়ে এসব কাজ করছেন। শুধু দখল আর ভরাটই নয়, পুরো এলাকাজুড়ে খালে ময়লা আবর্জনা ফেলে এক রকম অস্বস্থিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘এই মরা খালের বর্জ্যের দুর্গন্ধে হাটার সময় পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসতে চায়।’
ব্যবসায়ী মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘যত দখল আর ভরাট এই খালে। অতচ বাজারের একমাত্র পানির উৎস এটি। এলাকাবাসীর স্বার্থে এটি রক্ষা করা দরকার। দখল, ভরাট ও দূষণ থেকে সকলে মুক্ত হওয়া জরুরি।’
নাজিরহাট আদর্শ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ জালাল বলেন, ‘এখানে আবর্জনা ফেলার কোনো জায়গা নেই। ফলে বাজারের কিছু ব্যবসায়ী খালটিতে ময়লা আবর্জনা ফেলে দূষণ করছেন। এটি কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়।’
নাজিরহাট ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া বলেন, ‘খালটির কিছু অংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন। বাকি পুরোটাই খাল। আমরা নিয়মিত অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করি। কিন্তু তাতেও তারা দমে না।’
নাজিরহাট পৌরসভার মেয়র এ কে জাহেদ চৌধুরী বলেন, ‘বাজারের পানি নিষ্কাষনের অন্যতম মাধ্যম এটি। একসময় খরস্রোতা ছিল। বর্তমানে এটিতে বিভিন্নভাবে আগ্রাসন চলছে। বাজারের পয়:প্রণালি ও বর্জ্য এ খালে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া খালটির বিভিন্ন অংশে ভরাট হওয়ায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বিষাক্ত পানির আগ্রাসন বেড়েছে। তিনি দাবী করেন, যে যার মত করে দখলের ফলে খালটি নিজস্বতা হারিয়েছে। এটি বন্ধ হওয়া দরকার।’
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘ঊর্ধতনদের সাথে কথা বলে খালটি পূর্বের অবস্থায় ফেরাতে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হবে। এছাড়া অবৈধ দখলদার ও দুষণের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিলনা। দখল, ভরাট ও বর্জ্য না ফেলার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আছে। দ্রুত অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় এনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’