পাহাড়ে অবৈধ বসবাস, রয়েছে পানির গভীর নলকূপ, চলাচলের জন্য রয়েছে ঢালাই
করা রাস্তা ও সিঁড়ি
ভূঁইয়া নজরুল »
খুরশিদ আনোয়ার। বয়স ৭০ এর বেশি হবে। বসবাস করেন কৈবল্যধাম লেকসিটি আবাসিক এলাকার পূর্বদিকের রেলওয়ের পাহাড়ের ঢালে। শুধু তিনি নন, এই পাহাড়ি এলাকায় প্রায় হাজারো পরিবারের বাস রয়েছে। ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড়গুলোতে ওঠার জন্য আরসিসি ঢালাই দিয়ে সিঁড়ি বানানো হয়েছে। সেই পাহাড় চূড়ায় রয়েছে পানি সরবরাহের জন্য পাইপ লাইনের ব্যবস্থা। রয়েছে বিদ্যুতের সংযোগ এবং সেইসাথে বিনোদনের জন্য রয়েছে ডিশের লাইন। দুই বা তিন পাহাড়ের সংযোগস্থলে তৈরি করা হয়েছে টং দোকান। সেখানে বসে বঙ্গোপসাগর দেখার অনুভূতিই আলাদা। পুরো নগরের দৃশ্যও উপভোগ করার মতো। তাহলে সেই পাহাড়ে বসতি গড়ে উঠবে না কেন?
বর্ষা মৌসুম এলে পাহাড়ি এলাকার বসতি নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। প্রশাসনের লোকজন গিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু সারা বছর যারা এখানে বসবাস করছে, ঘর নির্মাণ করেছে, সেই ঘরে তারা আসবাবপত্র রেখেছে। বর্ষার বৃষ্টির জন্য কি তারা সেখান থেকে এক বা দুই মাসের জন্য চলে আসবে? মোটেও না। প্রবল বৃষ্টি হলেও তারা আসবে না। আর এই না আসার কথাটি যারা বসবাস করেন তারা যেমন জানেন তেমনিভাবে যারা উচ্ছেদ করতে যান তারাও জানেন। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায়ও বারবার এই কথাটি উঠে এসেছে। গত দুদিন পাহাড়ি এলাকাগুলো ঘুরে এবং সেখানকার বসবাসকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রেলওয়ের মালিকানাধীন লেকসিটির পূর্ব দিকের সেই পাহাড়ে বসতি গড়ে উঠেছে ২০০৪ সালের দিকে।
রেলওয়ের মালিকানাধীন ফয়’স লেককে যখন পরিচালনার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কনকর্ডকে দিয়ে দেয়া হয় তখন লেকের ভেতরের অংশের বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করা হয়। সেখানকার বসবাসকারীরা গিয়ে ঘর নির্মাণ করে রেলওয়ের মালিকানাধীন পাশের পাহাড়ে। রেলওয়ের প্রত্যক্ষ ইচ্ছায় তখন তাদের স্থানান্তর করা হয়েছিল। সেই পাহাড়ে গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। নলকূপ থেকে পানি পাহাড়ের চূড়ায় থাকা একটি ট্যাংকে সরবরাহ করা হয়। সেই ট্যাংক থেকে প্লাস্টিকের পাইপে প্রতিটি ঘরে ঘরে পানি সরবরাহ করা হয়। এমনকি বিদ্যুতের মিটারও রয়েছে। রয়েছে আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থাও। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে আরসিসি ঢালাই করা রাস্তাও নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে।
শুধু ওই পাহাড়ি এলাকা নয়, ফয়’স লেক এক নম্বর ঝিল, লালখান বাজার মতিঝর্না, বাঘঘোনা, বাটালি হিল, জালালাবাদ কৃষ্ণচূড়া আবাসিক এলাকার উত্তরের পাহাড়ি এলাকাসহ নগরীর সকল পাহাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ বসতিতে নাগরিক সুযোগ সুবিধার বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ রয়েছে। রয়েছে রাস্তা সুবিধাও। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন রাস্তা নির্মাণ করে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল প্যানেল মেয়র গিয়াস উদ্দিনের কাছে। তিনি বলেন,‘ নাগরিক সেবা দিতে আমরা রাস্তা নির্মাণ করেছি। ওখানে যেহেতু মানুষ বসবাস করছে তাই তাদের সেবা দেয়া হয়েছে।’
কিন্তু অবৈধ বসতিতে কেন রাস্তা করে দেয়া হলো এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৈধ ও অবৈধ বিষয়টি দেখবে প্রশাসন। বসতি নির্মাণের সময় তাদের বাধা দেয়া দরকার ছিল।
বিদ্যুতে বসতি বাড়ছে পাহাড়ে
শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আশরাফ উদ্দিন বলেন,‘ সকল কিছুর মূলে হলো বিদ্যুৎ। এসব অবৈধ এলাকায় পানি ও গ্যাসের কোনো বৈধ বা অবৈধ সংযোগ নেই। কিন্তু বিদ্যুতের বৈধ সংযোগ রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, বিদ্যুৎ থাকার কারণে মানুষ বিনোদনের সব সুুবিধা পাচ্ছে, পাম্প বসিয়ে মোটরের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করতে পারছে। স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগও পাচ্ছে। যথারীতি পাহাড়ের অবৈধ বসতিতে উৎসাহিত হচ্ছে মানুষ।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রায় সব মিটিং এ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছু হয় না। একদিন বা দুই দিন বন্ধ থাকার পর আবারো সংযোগ পেয়ে যায় এবং মানুষ স্বাভাবিকভাবে বসবাস করতে থাকে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন,‘ আমরা লালদিয়া চর উচ্ছেদের সময় পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম। কোনো ধরনের সংঘাত ছাড়াই পুরো এলাকা উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়েছিল। পাহাড়েও এসব সেবা সমূহ বন্ধ করে দিলে মানুষ সেখানে বসবাস করতে নিরুৎসাহিত হবে।’
স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে বাড়ছে বসতি
জেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ে বসতি উচ্ছেদে গেলে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। নগরীর লালখান বাজার এলাকায় স্থানীয় দুই জনপ্রতিনিধি (কবির আহমেদ মানিক ও মনোয়ারা বেগম মনি )ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় রেলওয়ে, ওয়াসা ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের জায়গায় ঘর তোলা হয়েছে। এসব ঘরের ভাড়াও তারা পেয়ে থাকে। অপরদিকে ফয়’স লেক এক নম্বর ঝিল, লেকসিটির পূর্ব দিকের পাহাড়সহ আশপাশের এলাকাগুলোতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জহুরুল আলম জসিমের ছত্রছায়ায় বসতি গড়ে উঠেছে। পাহাড়ে কেন ঘর তুলতে সহায়তা করা হয়েছে মিডিয়ার এমন প্রশ্নের জবাবে পাহাড় ধসের দুর্ঘটনার দিন ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম বলেন, ‘ সরকারের পক্ষ থেকে সবার জন্য আবাসন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে, তাই তা করা হয়েছে। একইভাবে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিতে বিদ্যুতের লাইন নেয়া হয়েছে।’ শুধু এই এলাকা নয়, নগরীর সব পাহাড়ি এলাকায় এ ধরনের স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বসতি গড়ে উঠে। এবিষয়ে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আশরাফ উদ্দিন বলেন,‘ আমরা বসবাসকারীদের তালিকা করছি, কিন্তু কাদের ছত্রছায়ায় এগুলো গড়ে উঠছে সেই তালিকা করা হয়নি।’
রেলওয়ের পাহাড়ে সবচেয়ে বেশি অবৈধ বসতি
লালখান বাজার মতিঝর্না, বাটালি হিল, টাইগারপাস হিল, ফয়’স লেকের পুরো পাহাড়ি এলাকাসহ নগরীর বেশিরভাগ পাহাড় রেলওয়ের মালিকানাধীন। আর তাদের পাহাড়েই অবৈধ বসতির পরিমাণ বেশি। এবিষয়ে পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের চিফ এস্টেট অফিসার সুজন চৌধুরী বলেন, ‘রেলওয়ে রেললাইন সচল রাখতে গিয়ে পাহাড়ের অবৈধ বসতির দিকে নজর দেয়া সম্ভব হয় না। এছাড়া এসব কাজে পর্যাপ্ত জনবলও নেই। আমাদের জায়গায় প্রায় ৩০ হাজারের বেশি পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে।’
এদিকে গত শুক্রবার দিবাগত রাতে ফয়’স লেক এক নম্বর ঝিল এলাকায় পাহাড় ধসে দুজনের মৃত্যুও পর সেই এলাকা থেকে ১৮০ ঘর উচ্ছেদ করা হয়। এখন সেই উচ্ছেদকৃত এলাকায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গাছ লাগিয়ে দেয়া হবে এবং তা মেইনটেনেন্স করার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে।
ঘর পাবে পাহাড়ের বসতিরা
সমতলের গৃহহীন মানুষগুলো যেমন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে গৃহ সুবিধা পেয়েছেন। তেমনিভাবে পাহাড়ের বসতিরাও তেমন গৃহের সুবিধা পেতে যাচ্ছেন। এবিষয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন বলেন,‘ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আমরা এধরনের একটি মেসেজ পেয়েছি। আগামী এক মাসের মধ্যে পাহাড়ের বসতিদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হবে। সেই তালিকা অনুযায়ী পরবর্তীতে তাদের পুনর্বাসন করা হবে।’
এদিকে ২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড় ও দেয়াল ধসে ১৩২ জনের প্রাণহানির পর সরকারের পক্ষ থেকে লালখান বাজার মতিঝর্না এলাকার বসতিদের জন্য একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই ভবনে বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের পরিবর্তে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবন পুনর্বাসিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বালির আধিক্য বেশি থাকার কারণে একটানা বৃষ্টি হলে এসব পাহাড় নিচের দিকে ধসে পড়ে। আর এই ধসে পড়াকে গতিশীল করে পাহাড়গুলো খাঁড়াভাবে কেটে বসতি নির্মাণের কারণে। আর এতে প্রতিবছর চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। গত শনিবারের পাহাড় ধসে চট্টগ্রামের দুই স্থানে পাহাড় ধসে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।