সুব্রত চৌধুরী »
ডিসেম্বর মাস। গত ক’দিন ধরেই শীতটা বেশ জাঁকিয়েই পড়ছে, অন্তুর আজকে কোচিং সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। পড়ালেখার চাপে তার জেরবার অবস্থা। শীতে জবুথুবু হয়ে বাসায় ফিরে নাকে মুখে কিছু গুঁজেই আবার পড়ার টেবিলে। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। ক্লাসের ফার্ষ্ট বয় বলে কথা। কোথাও একটুকুন ফাঁক রাখার সুযোগ নেই। একটু ফাঁকি দিলেই চোখের পলকেই সব ফসকে যাবে।
আর মার যা পুলিশী তদারকি, ফাঁকি দেওয়ার সুযোগই নেই। তাই সব সময় তাকে দৌঁড়ের ওপর থাকতে হয়। পড়ালেখার পাশাপাশি সৃজনশীল কর্মকাণ্ডেও তার সক্রিয়তা কারো অজানা নয় । শহরের তুখোড় বিতার্কিক, আঁকিয়ে হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছে অনেক আগেই, গানের গলাও মুগ্ধতার আবেশ ছড়ানোর মতো। বিশেষ করে দেশের গান সে বেশ ভালোই গায়।
কোচিং ও স্যারের পড়া শেষ করতে করতে ঘড়ির কাঁটা দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা ঢং ঢং শব্দে রাত নিশুতির কথা জানান দেয়। অন্তু ঘন ঘন হাই তুলতে থাকে, চোখ দুটোর পাতা মুদে আসে। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে সে পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। অন্তু নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারে না। প্রথমে সে ভেবেছিল ঘুম ঘুম চোখে ভুল দেখছে না তো! ভালো করে চোখ দুটো রগড়িয়ে নেয়। না ঠিকই তো, হুইল চেয়ারে বসা মুক্তিদাদু তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।
অন্তু অবাক চোখে জিজ্ঞেস করে, মুক্তিদাদু তুমি?
হ্যাঁ, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?
সত্যিই দাদু বিশ্বাস হচ্ছে না।
বিশ্বাস না হবারই কথা।
পাশের চেয়ারটাতে বসো মুক্তিদাদু।
তা এতো রাত পর্যন্ত কী পড়ছো? চেয়ারে বসতে বসতে মুক্তিদাদু বলেন।
স্যার আর কোচিংয়ের পড়া রেডি করছি।
তাইতো দেখছি, গাদা গাদা বইতে টেবিল তো ভর্তি করে রেখেছো।
বেশিরভাগই তো রেফারেন্স বই।
তাই!
হ্যাঁ দাদু।
বিজয় দিবস তো দরজায় কড়া নাড়ছে।
ঠিক বলেছো।
বিজয় দিবসে তোমাদের পরিকল্পনা কী?
অন্যান্যবারের মতো এবারও বেশ ঘটা করেই বিজয় দিবস পালন করবো। কিন্তু এবছর আমার মন খারাপ।
কেন?
এবছর অনুষ্ঠানে তুমি উপস্থিত থাকতে পারবে না, তোমাকে খুব মিস করবো। গত বছর তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে।
না না, মন খারাপ করো না, আমার অন্য সহযোদ্ধারা রয়েছে না।
দাদু একটা আইডিয়া মাথায় ঘুরছে, তোমার সাথে শেয়ার করবো?
বলো।
এবারের অনুষ্ঠানে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণে “আমার চোখে মুক্তিযুদ্ধ” শীর্ষক উপস্থিত বক্তৃতার আয়োজন করবো।
তোমার মাথায় এই আইডিয়াটা কেন আসলো?
আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে ভুলতে বসেছে এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তারা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাবে।
বেশ ভালো আইডিয়া। আর এভাবেই বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চর্চাটা অব্যাহত রাখতে হবে।
হ্যাঁ, সেই চিন্তা থেকেই আমি এই প্রতিযোগিতাটির আয়োজন করেছি।
অনুষ্ঠানে তুমি দেশের নতুন কোনও গান গাইবে?
না দাদু, এবার আমি দেশের গান করবো না।
সে কী! কেন?
এবার আমি ভিন্ন কিছু পরিবেশন করবো।
যেমন?
আইস ফ্যাক্টরি রোডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে তোমার ডান পা হারিয়েছিলে, সেই বীরত্বের কাহিনী আমি এবার কণ্ঠে ধারণ করবো।উপস্থিত সবাইকে শোনাবো সেই বীরত্বের কাহিনী। অন্তুর মুখে আইস ফ্যাক্টরি রোডের যুদ্ধের কথা শুনে মুক্তি দাদুর শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায়, ফ্ল্যাশব্যাকে তিনি ফিরে যান একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনে। তার দু’চোখ ঠিকরে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হয়ে আসে।
মুক্তিদাদু তুমি চুপ করে আছো যে?
কই নাতো?
আমার কাছে লুকাতে চেষ্টা করো না।
একটু নষ্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম।
ওহ আচ্ছা!
এভাবেই দাদু স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।
ঠিক বলেছ দাদু। কথা বলতে বলতে গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা ঢং ঢং শব্দে রাত নিশুতির কথা জানান দিতেই থাকে। আর তা শুনে মুক্তিদাদু বলেন, কালকে সকালে তো তোমার স্কুলে কোচিং আছে, তাই না?
হ্যাঁ ।
এখন ঘুমোতে যাও।
ঠিক আছে।
আমি আসছি
তোমার সাথে কথা বলে আমার খুব ভালো লেগেছেমুক্তিদাদু।
আমারও, আসি।
আবার এসো মুক্তিদাদু।
হঠাৎ মার গলার শব্দে অন্তু সম্বিৎ ফিরে পায়।
কিরে রাত ক’টা বাজে খেয়াল আছে? এখনো ঘুমোতে যাও নি?
যাচ্ছি মা।
এতোক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলে?
কই! কারো সাথে না তো।
আমি তোমার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেলাম তুমি কারো সাথে কথা বলছো।
মুক্তিদাদুর সাথে মা।
কী! তোমার কী মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে?
মাথা খারাপ হবে কেন মা?
মুক্তিদাদু তো গত বছর মারা গেছেন! আর তুমি বলছো কিনাৃ সত্যিই তো।
সত্যি! মা ভেংচি কাটতে কাটতে বলেন।
তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না মা?
আর বিশ্বাস করতে হবে না।যাও, এখন ঘুমাতে যাও, অনেক রাত হয়েছে। আমি দরজাটা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিচ্ছি।
অন্তু খাটে শুতে গিয়েই হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় পড়ার ঘরের দেওয়ালে ঝুলানো মুক্তিদাদুর ছবির ওপর । মুক্তিদাদুর ছবিটার ওপর ফুলের মালা ঝুলছে, মা পরিয়ে দিয়েছেন। ক’দিন আগেই মুক্তিদাদুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে ।
ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে যেতে অন্তুর কানে বাজতে থাকে, “মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান,লেখা আছে অশ্রুজলে…।