শ্যামল রুদ্র, রামগড় »
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি টিলা-উপত্যকায় বারোমাসি জাতের কাঁঠাল বাগান কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। সুপরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হলে এটি হবে কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। প্রত্যন্ত এলাকার প্রান্তিক শ্রেণির কৃষক বাগান সম্প্রসারণে সরকারি প্রণোদনা চান। তাদের চাওয়াটাও যৌক্তিক।
সমতল জেলার তুলনায় এখানে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই গরিব। কায়ক্লেশে জীবন চলে। নূন আনতে পানতা ফুরায়। এরকম পরিস্থিতিতে সরকারি প্রণোদনা পেলে কৃষকদের বেশ উপকার হতো বলে মনে করেন পাহাড়ের কৃষকরা। এতে বছরব্যাপী জাতীয় ফলটির ব্যাপক ফলন পাওয়া যেতো। অমৌসুমী হওয়ায় এর চাহিদাও থাকত বেশি। এমনিতেই পাহাড়ের টিলাভূমিতে মৌসুমী কাঁঠালের প্রচুর ফলন হয়। এখানে বসবাসরত প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারের বসতভিটায় কাঁঠালের কমবেশি ফলন দেখা যায়। বিশালাকৃতির কাঁঠাল বাগানও আছে অনেকের। তবে এগুলো সবই মৌসুমী, ফলনও হয় প্রচুর। কিন্তু একসঙ্গে ফলন আসায় তখন দাম কম থাকে। বাজারমূল্য ভালো পাওয়া যায় না, অনেক সময় পচে গলে নষ্ট হয়।
এ রকম অবস্থায় অমৌসুমী বারোমাসি জাতের কাঁঠালের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দেখছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ উদ্যোগ সফল হলে কৃষক লাভবান হবেন। কিছু পয়সাপাতি ঘরে ওঠবে কৃষকের। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে জীবন মানে আসবে উন্নতি। দু’বেলা পেটপুরে খেয়েদেয়ে মানসিক প্রশান্তিতে থাকবেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় পাহাড়াঞ্চল কৃষি গবেষণা কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৬৪ সালে। এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পিএসও) ড. এস এম ফয়সল। তিনি কৃষকদের মাঝে ব্যাপকভাবে অমৌসুমি কাঁঠাল বাগান সৃজনে উদ্যোগ নেন। যদিও আগে থেকেই সীমিত পরিসরে পাহাড়ে বারোমাসি কাঁঠালের চাষ হত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পিএসও সাহেব তাঁর বন্ধু ড. মো. জিল্লুর রহমানকে ঢাকা গাজীপুর থেকে রামগড় এনে কৃষকদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
পরিচয়ের সূত্রধরে এই প্রতিবেদকও প্রশিক্ষণ কর্মশালায় গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। এখানে বাগান চাষীদের খুবই উচ্ছ্বসিত ও আন্তরিক মনে হয়। প্রশিক্ষণলব্দ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এলাকায় ফলচাষে সমৃদ্ধি আনার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন সবাই। কর্মশালাটি খুবই উপকার হয়েছে বলে উল্লেখ করেন কৃষকেরা। এখান থেকে ফল চাষের নানা পদ্ধতিসহ অনেক কিছু শিখেছেন। সরকারি প্রণোদনার সুযোগ চান এখন তাঁরা। যেহেতু বহুবর্ষজীবী এই বারি কাঁঠাল-২ ও ৩, তাই সরকারি সহযোগিতা ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় পাহাড়ে বাগান সম্প্রসারণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চান। একজন তো বলেই বসলেন ‘কাঁঠাল বাগান করে বাংলাদেশকে পয়সাওয়ালা (ধনী রাষ্ট্র) বানিয়ে ফেলবেন। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে টনে টনে কাঁঠাল বিদেশে পাঠাবেন। বৈদেশিক মুদ্রা আসবে বিদেশ থেকে। হাতে নিয়ে ডলার-পাউন্ড গুনবেন।’ পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার পাহাড়াঞ্চল কৃষি গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক উদ্ভাবিত বারোমাসি জাতের কাঁঠাল কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা গেলে দেশের জাতীয় ফলটি বছরজুড়ে সহজলভ্য হবে। আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কাঁঠালের বাণিজ্যিক পরিধি আরও বৃদ্ধি করাও সম্ভব।
কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) বারোমাসি কাঁঠালের জাত উদ্ভাবন শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ‘কাঁঠাল উৎপাদনে আধুনিক কলাকৌশল’র ওপর কৃষক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আগত কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষক ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এ রকমই ধারনা পাওয়া যায়।
গত জুলাই মাসের ৯ তারিখ খাগড়াছড়ির রামগড় পাহাড়াঞ্চল কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সেমিনার কক্ষে এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। ফল বিভাগ উদ্যানতত্ত্ব বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের আয়োজনে ৩০ জন ফল চাষীসহ ৪০/৫০জনের মতো প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন।
প্রকল্পের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ও ফল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান প্রশিক্ষণার্থীদের উদ্দেশে কাঁঠাল চাষের আধুনিক কলাকৌশল অত্যন্ত সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলেন। পাশাপাশি কাঁঠালের গ্রাফটিং পদ্ধতি ও অন্যান্য উৎপাদন প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ দেন এবং মাঠ পর্যায়ে কাঁঠালের কাক্সিক্ষত উৎপাদনে বিদ্যমান সমস্যা ও এর প্রতিকার সম্পর্কে প্রশিক্ষণার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে সারা বছর ভোক্তা যেমন মানসম্পন্ন কাঁঠাল খেতে পাবেন তেমনি প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্যও কাঁঠাল হবে সহজলভ্য। তখন দেশে কাঁঠালের উৎপাদন বহুগুন বৃদ্ধি পাবে, পাশাপাশি জনগণের পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
প্রসঙ্গত, রামগড় পাহাড়াঞ্চল কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানিরা সর্ব প্রথম বারোমাসি বারি কাঁঠাল-২, ২০১১ সালে এবং বারি কাঁঠাল-৩, ২০১৪ সালে উদ্ভাবন করেন। বারি কাঁঠাল-২ জাতের কাঁঠাল গাছে ফল ধরবে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। সাধারণত মৌসুমি কাঁঠাল পাওয়া যায় মে থেকে জুলাই পর্যন্ত।
এ কাঁঠালের গড় ওজন সাত কেজি। এটি খুবই সুস্বাদু। মিষ্টতার পরিমাণ শতকরা ২১ ভাগ, খাওয়ার উপযোগী অংশ ৬০ ভাগ এবং ভেতরের রং উজ্জ্বল হলুদ।
অন্যদিকে, বারি কাঁঠাল-৩ উচ্চ ফলনশীল বারোমাসি জাত। সেপ্টেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। সাইজ মাঝারি আকারের, ওজন ৫/৬ কেজি, কাঁঠালের কোষ হালকা হলুদ, মধ্যম রসালো, মিষ্টতা শতকরা ২৩.৬ ভাগ ও খাদ্যোপযোগী অংশ ৫২ ভাগ। সব এলাকায় চাষযোগ্য তবে পাহাড়ি টিলা বিশেষভাবে উপযোগী।
সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা মনে করেন, অমৌসুমি বা বারোমাসি হওয়ায় বারি-২ ও বারি-৩ জাতের কাঁঠালের বাগান করে প্রচুর লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একরপ্রতি ৪০টি গাছ লাগিয়ে ২৪ টন ফল পাওয়া যাবে। সার, মজুরি ও জমির লাগিয়তসহ একরপ্রতি খরচ হবে প্রায় দেড় লাখ টাকা। উৎপাদিত কাঁঠাল বিক্রি করা যাবে অন্তত সাড়ে আট লাখ টাকা। খরচ বাদ দিয়ে লাভ হবে প্রায় সাত লাখ টাকা।
গবেষণা কেন্দ্রের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুনীল দেবনাথ জানান, পাহাড়ি অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় ফলের মৌসুমে কৃষকেরা দূর-দূরান্ত থেকে কাঁঠাল পরিবহন করে এনেও যথাযথ মূল্য পান না। এ ক্ষেত্রে এ জাতের কাঁঠালের চাষ চাষিদের ভাগ্যোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, এ সময়ে মাঝারি (পাঁচ থেকে ছয় কেজি) একটি কাঁঠাল বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, পাহাড়ের মাটি কাঁঠাল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। সাধারণত কাঁঠালের বীজ থেকেই চারা তৈরি করা হয়। এতে গাছের মাতৃ বৈশিষ্ট্য বজায় না থাকলেও ফলনে বিশেষ তারতম্য দেখা যায় না। পাকা কাঁঠাল থেকে পুষ্ট বড় বীজ বের করে ছাই মাখিয়ে দুই থেকে তিন দিন ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হয়। এর পর বীজ তলায় বপন করলে ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে চারা গজাবে। এক থেকে দুই মাসের মধ্যে চারা সতর্কতার সঙ্গে তুলে পলিব্যাগে রাখতে হবে এক বছর। এরপর চারা রোপণ করতে হবে মাটিতে। জাতের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ রাখতে লাগাতে হবে গ্রাফটিং বা টিস্যু কালচারের চারা।
চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় জুন থেকে আগস্ট মাস। গাছ ও সারির দূরত্ব হবে ১০ মিটার। গাছ রোপণের ১৫ দিন আগে এক বর্গমিটার ব্যাসের গর্ত তৈরি করে ২০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ২০০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা লাগানোর এক মাস পর ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে গাছপ্রতি ২০০ গ্রাম। প্রতিবছর শতকরা ১০ ভাগ সার বাড়িয়ে দিতে হবে। একরপ্রতি গাছের সংখ্যা হবে ৪০টি এবং ফলন হবে ২৪ টন।