‘বাতিঘরে’ বইতে বুঁদ শিশুরা

শিশুদের জন্য বাড়ছে ১ হাজার বর্গফুট জায়গা

হুমাইরা তাজরিন »
‘বাতিঘর’ – সেই সুউচ্চ মিনার যেখান থেকে বিশেষ আলো ফেলে সমুদ্রে চলমান জাহাজের নাবিককে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। জ্ঞান সেই আলো যা আমাদের জীবনে সঠিক পথ প্রদর্শন করে। আর সেই জ্ঞান আহরণের অন্যতম মাধ্যম বই। চট্টগ্রামে বাতিঘর নামে একটি বইয়ের দোকানকে কেন্দ্র করে সব বয়সী মানুষের মাঝে বই পড়ার ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। তবে বাতিঘরে বইয়ের প্রতি শিশুদের আগ্রহই লক্ষ্য করা গেছে। তাই অচিরেই কেবল শিশুদের জন্যেই ১ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে বর্ধিত হচ্ছে বাতিঘরের চট্টগ্রাম আউটলেটের পরিসর।
শিশু সঞ্চিতা দত্ত এসেছে বাতিঘরে বই কিনতে। দুটো বই কেনা হলেও বাবার কাছে বায়না করছে আরো দুটো বই তার চাই। এই বায়নায় বোধ কোনো অভিভাবকই নারাজ হতে পারেননা। সঞ্চিতা জানায়, তার ছবি আঁকা বইগুলো পড়তে ভালো লাগে।
সঞ্চিতকে নিয়ে বাতিঘরে এসেছিলেন বাবা সঞ্জীব দত্ত, তিনি বলেন,‘ আসলে আমি আমার সন্তানদের যথাযথ বিকাশ নিয়ে কিছুটা শংকিত ছিলাম। আমাদেও তো ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয় জীবিকার তাগিদে। এই ব্যস্ততার কারণে ও যে সময়টা আমাদের কাছে ডিমান্ড করে সেটা আমরা দিতে পারছিনা। খেয়াল করলাম বাধ্য হয়ে হলেও ওকে আমরা প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত করে ফেলছি। যার কারণে ওর মধ্যে মানবিকতাবোধের বিকাশ যথাযথভাবে হচ্ছেনা। আমাদের সান্নিধ্য ও চাইছেই না। তাই আমার কাছে মনে হলো ওর এই আগ্রহের রূপান্তর ঘটাতে হবে। এর জন্য বইয়ের চেয়ে ভালো বিকল্প আর কিছু হতে পারেনা। সময় পেলেই তাই এই সুন্দর পরিবেশটাতে ওকে নিয়ে চলে আসি। অনেক পড়া হয়। বই কিনে নিয়ে বাড়িতেও পড়া হয়। বাতিঘর শিশুদের জন্য পরিসর বড় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেনে আরো উৎফুল্লবোধ করছি।’
বইকে বলা হয় বন্ধু। কারণ বই থেকে পাওয়া অমূল্য জ্ঞান কখনও হারায় না। বই মানুষকে সমৃদ্ধ করে। একজন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বই বিশেষ ভূমিকা রাখে। কিন্তু সচেতন মানুষ মাত্রই স্বীকার করবেন যে প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে বই পড়ার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। মুঠোফোনে ভিডিও,রিলস, গেইম এসব দেখার প্রতিই শিশু কিশোর হতে শুরু করে বয়ঃবৃদ্ধদের ঝোঁক এখন বেশি। শিশুকে খাবার খাওয়ানো হতে ঘুম পাড়ানো সকল কাজেই প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল অভিভাবকরা। বিদ্যালয়, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ পড়াশোনাও এখন অনেকটা প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে। বিভিন্ন লেখকের বইয়ের পিডিএফ ভার্সনই পড়ে নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। নগরীর জামালখানে অবস্থিত ‘বাতিঘর’ বইয়ের দোকানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সব ধরনের দেশি বিদেশি বইয়ের বিভাগ রয়েছে এখানে। নেই আরাম কেদারা কিংবা পড়ার টেবিল। এখানে ওখানে পাতা ছোট ছোট বেঞ্চিতে বসে হাতের উপর বই ধরে একমনে পড়ছেন পাঠকেরা। কেউ একেবারে সিনিয়র সিটিজেন, বর্ষীয়ান লেখকদের প্রবন্ধ পড়ছেন। কেউবা মধ্যবয়সী , কবিতা কিংবা প্রিয় লেখকের উপন্যাস। কেউ একেবারেই তরুণ হয়তো শেষের কবিতার অমিতের কাব্যালাপে মজেছেন। যারা কৈশোর পেরিয়েছে তারা খুঁজছেন হুমায়ুন আহমেদের হিমু আর রূপাকে। কিশোর কিশোরীদের পছন্দ ফিকশন, গোয়েন্দা কাহিনী। আর শিশুদের তো আগ্রহের শেষ নেই। বইয়ের প্রতি এমন ভালোবাসা যত্রতত্র চোখে পড়েনা। নতুন বই এলেই এখানে বাগিয়ে নেওয়ার তাড়া পড়ে যায়। দোকানের কর্মীরাও সারাদিন বেশ ব্যস্ত সময় কাটান। তবে ব্যস্ততা বাড়ে বিকেলের পর। সম্প্রতি বিকেল পেরোলেই অভিভাবকদের মধ্যে শিশুদের নিয়ে বাতিঘরে আসার বিশেষ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বই কেনা হোক বা না হোক বই পড়ছেন প্রায় সকলেই। বাতিঘরে আছে শিশুদের জন্য আলাদা কর্নার। যেখানে বয়সভেদে শিশুদের আলাদা আলাদা বই রয়েছে।
অভিভাবকদের মতে, প্রযুক্তি নির্ভরতার যুগে বইয়ের প্রতি ভালোবাসার উন্মেষ ঘটানোর বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। তাই সচেতন অভিভাবকগণ সন্তানকে শৈশবেই পরিচয় করাচ্ছেন বন্ধু বইয়ের সঙ্গে। শিশুদের এই আগ্রহের কথা মাথায় রেখে প্রেস ক্লাব ভবনের ২য় তলায় ১ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে তৈরি হচ্ছে বাতিঘরের বর্ধিত অংশ। যেখানে শিশু কিশোরদের সব ধরনের দেশি-বিদেশি বই পাওয়া যাবে। কেনাকাটার পাশাপাশি বরাবরের মতো বই পড়াও যাবে নির্বিঘ্নে।
এ সম্পর্কে বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দে বলেন,‘ বাতিঘর কেবল চট্টগ্রামে নয় ঢাকা ,রাজশাহী এবং সিলেটেও রয়েছে। এছাড়াও ছোট পরিসরে ঢাকায় আরো ২টি শাখা রয়েছে। বর্তমানে প্রত্যেকটি শাখায় ছোটদের আনাগোনা বেড়েছে। অভিভাবকরা তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসছেন। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে শিশুরা অভিভাবকদের কাছে বায়না ধরে। কিন্তু আমাদের যে স্পেসটা ওদের জন্য রয়েছে ওটা খুব সংকীর্ণ হয়ে গেছে। ওরা যাতে আরো খোলামেলা জায়গায় ,আরো বেশি বই পড়তে ও কিনতে পারে। অন্যান্য শিশুরাও যাতে বই কিনতে পড়তে এখানে আসতে আগ্রহী হয় সেকারণে আমরা শিশুদের বই পড়ার পরিসরটাকে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই চট্টগ্রাম বাতিঘরের উপর তলায় ১ হাজার বর্গফুট জায়গা নেওয়া হয়েছে। যেখানে শিশু কিশোরদের দেশি বিদেশি সবরকম বই থাকবে। এটি আমরা চলতি বছরেই চালু করবো।’