নিলা চাকমা »
সময়টা ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি। এন্সি চাকমা , রেশমী চাকমা এবং দীপ্ত ত্রিপুরা তিন বন্ধু মিলে নগরীর আলফালাহ গলিতে বাসা ভাড়া নেয়। বাসায় দুটো রুম, দুটো টয়লেট, একটি করে বেলকনি ও রান্নাঘর রয়েছে। প্রতিমাসে মালিককে দিতে হয় ১২ হাজার টাকা। বাসাভাড়া বাদেও বিদ্যুৎবিল ১২০০ টাকা, গ্যাস বিল ১২০০ টাকা এবং ওয়াইফাই বিলের জন্য ১০০০ টাকা গুনতে হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ১৬ হাজার টাকা তিন জন মিলে পরিশোধ করে। ভাড়ার চাপ পড়ায় কয়েক মাস অতিক্রম হওয়ার পর তারা দুজন রুমমেট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২ জন রুমমেট বাড়তি নেয়ার পর তাদের উপর কমেছে বাড়তি ভাড়ার চাপ। কিন্তু বছর শেষ না হতেই আবার বাড়ি ভাড়া ১ হাজার টাকা বাড়ানোর নোটিশ আসে।
এন্সি চাকমা বলেন, ‘আমরা ২০২১ সালের শুরুতে এ বাসায় উঠি। এক বছর যাওয়ার পর বাসাভাড়া বাড়ানো হবে সে কথা আমাদের মালিক জানাননি। হঠাৎ কোনো কথাবার্তা ছাড়াই ১ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিতে বলেছেন। ৫০০ টাকা হলেও মানা যেত। বাড়তি ভাড়াটা আমাদের জন্য একটা বড় চাপ। বিদ্যুৎ বিলও বাড়ার খবর শুনেছি। পড়ালেখা প্রায় শেষ, মা বাবার থেকেও টাকা চাইতে অস্বস্তি হয়। গত চারমাস ধরে ভালো একটি চাকরি খুঁজে ব্যর্থ হয়েছি। এখন কি করে সামলাবো ঠিক বুঝতে পারছি না।
শুধু এন্সি-দীপ্তদের বাসা নয় নগরীর আগ্রাবাদ, দুই নম্বর গেইট, লালখান বাজার, ব্যাটারিগলি, মেহেদীবাগ, বহদ্দারহাট, চকবাজারে প্রায় সব এলাকার অনেক বাসায় এ বছর ভাড়া বাড়নোর খবর পাওয়া গেছে। সেখানে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন মালিকরা। বাড়তি ভাড়ার চাপটা সবচাইতে প্রভাব পড়ছে মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের। দ্রব্যমূল্যের সাথে বেড়েছে শিক্ষা উপকরণ এবং ফি। সবখানেই চাপ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। সমাধান হিসেবে অনেক শিক্ষার্থী বাসা ছেড়েছেন। সপ্তাহে দুয়েকবার শহরে এসে তাদের পরিচিত জনদের বাসায় থেকে ক্লাস করছেন। ক্লাস শেষ হলে আবার গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন।
সর্বশেষ বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রিত আইন ১৯৯১ এর ১৬ ধারার (২ ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে মানসম্মত ভাড়া বাড়ি-মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, প্রতি দুই বছর পর নিয়ন্ত্রক কর্তৃক ধারা ১৫ এর বিধান অনুযায়ী পুনঃ নির্ধারণ করা যাইবে।
সম্প্রতি ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে আগ্রাবাদ এলাকার এক বাড়ির মালিক ইব্রাহিম মুরাদ বলেন, ‘প্রাণঘাতী করোনার সময় আমরা ভাড়া কমিয়ে দিয়েছিলাম। এমনই আছে ঘর ভাড়া নেওয়াও হয়নি। এখন রড, সিমেন্ট, লোহা , রঙ এর পাশাপাশি বেড়েছে হোল্ডিং ট্যাক্স। সবকিছুর সাথে তো আমাদের সামঞ্জস্য রাখতে হবে। প্রতি বছর বাসা ভাড়া বাড়ানোর প্রসঙ্গে তিনি আরো জানান, বছর শেষ হলেই অনেক ভাড়াটিয়া বাসা ছাড়েন। সেই বাসায় তারা অনেক কিছুরই ক্ষতি করে যান। যেমন দরজার খিল ভেঙ্গে যাওয়া, পানির ট্যাপ, দেওয়ালের চামড়া উঠানোসহ অনেক মেরামতই আমাদের করতে হয়। একই সাথে নতুন বছর এলে ঘরের বিভিন্ন কাজ করতে হয়।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জরিপ বলছে, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে গড়ে ২০১১ সালে ১২শ বর্গফুটের পাকাবাড়ি ভাড়া ১২, ৮০০ টাকা এবং একই আয়তনের টিনশেড পাকাবাড়ির দাম ৭৮০০ টাকা। ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩, ৪৪০ টাকা এবং টিনশেড ৮,৪২৮ টাকা, ২০১৩ সালে ১৫,৩৯৫ টাকা এবং টিনশেড ৯,২৭০ টাকা, ২০১৪ সালে পাকাবাড়ি ১৭, ৩৬৮ টাকা এবং টিনশেডের বাসা ৯৭৩৫ টাকা, ২০১৪ সালে পাকা বাড়ি ১৮,১৫০ টাকা এবং টিনশেড ১০,০০০ টাকা। ২০১৫ সালে পাকা বাড়ি ১৯,৭০০ এবং টিনশেড ১০, ৯৬০ টাকা, ২০১৬ সালে পাকা বাড়ি ১৯, ৭০০ টাকা এবং টিনশেড পাকা বাড়ি ১০, ৯৬০ টাকা, ২০১৭ সালে পাকা বাড়ি ২১, ৩৪০ টাকা এবং টিনশেড ১১, ৮৫০ টাকা, ২০১৮ সালে পাকা বাাড়ি ২৩,০০০ এবং টিনশেড ১১, ২৫০ টাকা, ২০১৯ সালে পাকা বাড়ি ২৪, ৫৯০ টাকা এবং টিনশেড ১৩, ২৫০ টাকা, ২০২০ সালে পাকা বাড়ি ২৬, ৫২০ টাকা এবং টিনশেড ১৩,৬০০ টাকা, ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮,৫০০ টাকা এবং টিনশেড ১৪, ৫০০ টাকা বেড়ে যায়।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, অবশ্যই বাসাভাড়া বাড়বে। ভাড়া বাড়ানোর জন্য মালিকরা ডিসেম্বরেই বলে দিয়েছে। তা জানুয়ারি থেকে কার্যকর করবে। দুটো কারণে বাড়ানো হবে-(১) করোনার কারণে দু বছর অনেক মালিক ঘর ভাড়া বাড়াননি। তারা এখন বাড়াবেন। হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। ভাড়াতো বাড়াতেই হবে। এছাড়া রড, সিমেন্ট, লোহা, গ্যাস, বিদ্যুৎ সবকিছুই দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। দাম বাড়ানোর জন্য এই কারণগুলো দেখাচ্ছেন মালিক পক্ষ’।
বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া কল্যাণ সমিতির মহাসচিব সৈয়দ তৌকির আহমেদ বলেন, ‘প্রতি বছর জানুয়ারি মাস এলে ঘরভাড়া বাড়িয়ে দেন মালিকপক্ষ। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। একই সাথে শহরে পড়াশোনা করতে আসা শিক্ষার্থীরা পড়েন ভোগান্তিতে। করোনাকালে ঢাকাতে বাড়িভাড়া দিতে না পারায় এক শিক্ষার্থীকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নিয়মের বাইরে ভাড়াটিয়াদের কাঁধে বাড়তি ভাড়া চাপিয়ে দেওয়ার কারণে ২০১১ সাল থেকে আমরা আন্দোলন করে আসছি। ঢাকায় আমরা ক্যাবের সাথে সমন্বয় করে কাজ করছি। ১৯৯১ এবং ১৯৬৪ বিধানে দুটো বিধান চালু আছে। কিন্ত কারা আইনটা পাশ করবে সেখানে বিস্তারিত উল্লেখ নেই। ২০১৫ সালে ১ জুন উচ্চ ক্ষমতা কমিশন গঠন করার জন্য হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। কিন্তু সেই বিষয়ে এখনো কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আমরা- ক্যাব- এনজিওসহ এই ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছি। তবে ক্যাবের দাবি সারাদেশে ৫ কোটিরও বেশি ভাড়াটিয়া বাড়তি ভাড়ার চাপে রয়েছে। চট্টগ্রামে এই সংখ্যা ৩০ লাখের মতো। আমরা ২০১৫ সালে আল্টিমেটাম দিয়েছি এসব হয়রানি বন্ধে কার্যক্রম পদেক্ষেপ নেওয়ার জন্য। জানুয়ারি মাস আসলেই মালিক পক্ষ দাম বাড়ানোর নির্দেশ দেন। সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করলে এ সমস্যা সমাধান কার সম্ভব। এতে ভোগান্তি থেকে রেহাই পাবে ভাড়াটিয়ারা।