আসিফ উদ্দিন রিজভী »
যে জীবন ফেলে এসেছি তার জন্য আফসোস হয় যেন হামাগুড়ি দিতে দিতে একদিন দাঁড়িয়ে পড়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে চলা এই আমি এখন আর নিজের দিকে তাকাতে পারি না। নিজের দিকে তাকালেই মনে হয়, এ যেন আমি নই। খুব বিধ্বস্ত আর বিপর্যস্ত লাগে।
একটা এবড়োখেবড়ো পাথরের মতো এই জীবন আমার। যেটা সমুদ্রের স্্েরাতের ধাক্কায় ক্রমশ হয়ে উঠছে মসৃণ। কিন্তু আমি কি এই জীবন চেয়েছিলাম? প্রশ্ন করছি না কোন, আমি জানি, এই প্রশ্নের কোন জবাব থাকতে পারে না। আমি চেয়েছিলাম বলেই হয়তো আজ আমি এমন একটা জীবনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। এক জীবনের অর্ধেকটাই অপচয় করে ফেলেছি। স্্েরফ অপচয়। জীবনের সবগুলো ভুল কোথাও বসে মনে করার চেষ্টা করলে যে কয়েকটি ভুল আমার সামনে এসে দাঁড়ায় তার মধ্যে একটা হচ্ছে আমার আর দীপার সম্পর্কটা।
কোন একদিন আমি পথ ভুল করে চলে যাই দীপার কাছে। ভেবেছিলাম এই উথালপাতাল ঢেউয়ের ভিড়ে দীপাই হয়তো হতে পারে এক টুকরো আশ্রয়। আমি সেই আশ্রয়টুকু দু-হাতে আঁকড়ে ধরেছিলাম।
আমাকে যেদিন বাসা থেকে বলা হয়, তোমার বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দাও, শেষের দিকে গিয়ে গুছিয়ে উঠতে পারবে না। আমি সেদিন আমার পরিবারের সেই কথাকে সিরিয়াসলি নিই নাই। সহজ করে বললে, পাত্তা দিই নাই। মাধ্যমিকের পর আমি বাংলাদেশেই থেকে যাই।
আমি জানতাম, তারা আমাকে পড়াশোনার জন্য বাইরের দেশে পাঠানোর জন্য যে অস্থিরতা দেখাচ্ছে, সেটা আসলে তাদেও খেলার একটা অংশ। আমার শৈশব আমি নিজেই শেষ করে দিয়েছি। কৈশোর শেষ করে দিয়েছি এই পরিবারের ফাঁদে পা দিয়ে। শুধুমাত্র একটা ভালো রেজাল্টই সবকিছু নয়, সেটা আমি অনেক পরে এসে বুঝেছিলাম দীপার হাত ধরার পর।
খুব সম্ভবত প্রথম বর্ষেই আমি দীপার প্রেমে পড়ি। ইংরেজি সাহিত্যে পড়তো বলে তার সাথে আমার প্রায়ই দেখা হতো। আমাদের দুজনেরই কতগুলো কমন জায়গা ছিল, যেসব জায়গায় বই বিক্রি হতো, গান হতো, ইন্টেলেকচুয়াল মানুষের আনাগোনা থাকতো, সেসব জায়গায় আমাদের দেখা হয়ে যেত।
আমরা যে একসাথে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকতাম না তা বলছি না, হতাম, কিন্তু সেটা অনেক পরে।
সবগুলো দেখাই ছিল একেকটা স্টেপ। এভাবে দেখা হতে হতে আমি তার খুব কাছে চলে যাই। নিছকই ছেলেমানুষী গল্প। কখনো ভাবিনি প্রেম জিনিসটা আমার জীবনে আর কখনো আসতে পারে।
জীবনটাকে যতটা সম্ভব সহজ রাখতেই চেয়েছিলাম। প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আর আমি চাকরি পাচ্ছি না টাইপের নাটকের অংশ আমি কোন কালেই হতে চাইনি।
একদিন দীপা এসে জানতে চাইলো আমি ভাটিয়ালি গান শুনি কিনা?
হ্যাঁ, শুনি তো, বলেছিলাম আমি। তখন আমাদের খুবই ক্যাজুয়াল কথাবার্তা হতো। কেউ কাউকে পটানোর কোন চিন্তা ছিল না আমাদের মধ্যে।
আমি যখন বলেছিলাম, হ্যাঁ, ভাটিয়ালি গান আমার শোনা হয় মাঝেমধ্যে, তারপর সে প্রায় দুঘন্টা আমাকে বোঝায়, ভাটিয়ালি গানের জন্ম কিভাবে হয়, কোথায় হয়। আমি চুপচাপ তাকিয়ে থাকি তার দিকে। ওর প্রতিটি কথা যেন বহুযুগের ওপার থেকে প্রোষিতভর্তৃকা রমণীর কেঁদে চলার চিরায়ত সুর।ভাটিয়ালি গানের জন্ম ও বিকাশ আসলে পূর্ববঙ্গে হওয়ায় তার জন্য সবকিছু সহজ হয়ে যায়, কারণ, তার বাড়ি ফরিদপুর।
গান সম্পর্কে তার জানাশোনা ব্যাপক। নিজেকে ছোট মনে হত খুব। কারণ আমি সেসব শুনতামই না তেমন। সে সেটা বুঝত, আমাকে একবার কুইন শুনতে দেখে সে মুখের ওপর বলে বসে, এই ব্রিটিশ ব্যান্ডটা একটা বাজে ব্যান্ড! আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডাই, আই সামটাইমস উইশ উড নেভার বিন বর্ন এট অল!’ এই লিরিক শুইনা ইমোশনাল হইয়া যাও, রবি?
কথাটা বলার সাথে সাথে আকাশ কেঁপে উঠে। গুম ধরে যায় চারপাশ। জাহাঙ্গীর নগরের ক্যাম্পাসে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। এই মেয়ে পাগল না কী?
সে পাগল ছিল না। কোন একটা বিষয়ে সে হাত দিলে সেটাকে সে তছনছ করে ফেলতো পড়ে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী হওয়ার পরেও তার ভেতর যে বহুমাত্রিক জগৎ ছিল, মনের অজান্তেই আমি সেই জগতের ভেতর ঢুকে পড়ি। কিছু কিছু জিনিসের ঢোকার পথ থাকলেও বের হওয়ার কোন পথ থাকে না। আমি আর বের হতে পারিনি। প্রায়ই তাকে দেখতাম ফেসবুকের কমেন্টে ঝড় তুলছে। একেকটা অদ্ভুত লেখা লিখবে আর সেটা সম্পর্কে এই দুনিয়ায় কারো দ্বিমত থাকতে পারবে না। দ্বিমত থাকলেই আপনি শেষ। বাঁচতে পারবেন না। লজিক জিনিসটা তার ভেতর জন্মগত। তার ডিকশনারিতে হেরে যাওয়ার নামের কিছু নেই। একদিন সে ফেসবুকে যা লিখেছিল, তার সারমর্ম ছিল এই যে, বাংলাদেশের সাহিত্যে বালসালদের আসা শুরু হওয়ার পর থেকে সে আর বাংলা সাহিত্য পড়ে না!
কাউকে পরোয়া করে না সে। বাইওে থেকে দেখে মনে হতে পাওে সে খুবই স্ট্রং, দুঃখ জিনিসটা তার ভেতর নেই। তার বন্ধুরাও সেটা ভাবে। তার বাবাও তাকে নিয়ে তেমন চিন্তা করতো না। ব্রাইট ছাত্রী। লেখাপড়া ঠিকঠাক মতো করে তারপর মদের গ্লাসে হাত দেবে, এর আগে নয়। ওর জীবনে দুঃখ নেইÑ কথাটা ছিল পুরোপুরি মিথ্যে। দুঃখ ছিল। বসন্ত এলে তারও সব পাতা ঝরে যেত। খুব সহজে ভেঙে পড়তো সে।
হার্ট অব ডার্কনেস উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট মার্লোর মতো সে সব সময় আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতো। মানুষের চাহিদা যখন তার সীমানা পেরিয়ে যায় তখন তার ভেতর দুঃখরা বাসা বাঁধতে শুরু করে। দীপার ভেতরও সে রকম কিছু একটার জন্ম নিয়েছিল। খুব সম্ভবত তাই সে তার সেইসব বিরহবিধুর আত্মগত যন্ত্রণাকে হেসেখেলে উড়িয়ে দিতে চাইত সবসময়। আমি কিছু বলতাম না। সে কাঁদলে কখনো বলতাম না, কেঁদো না। সেইসব দিন আমি আজও দেখতে পাই মাঝেমধ্যে।
সবকিছু স্মৃতিতে ধরা দেয়। মাঝখান থেকে কিছু কিছু হারিয়ে গেছে। তবুও এলোমেলো ভাবে যা কিছু স্মৃতি এখনো বেঁচে আছে, তার যন্ত্রণাও খুব একটা কম নয়। কখনো ক্যাম্পাসে গেলে স্মৃতিতে সবকিছু ফিরে আসে। শহীদ মিনারে বসলে দূও থেকে তার সেইসব কান্নার শব্দ আমার বুক ভারী কওে তোলে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা আসলে জীবনের অনেক গুলো বছর পার কওে ফেলেছিলাম। পেছনের বছরগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা মাঝেমধ্যে হিসাবে বসতাম, কয়টা বিয়ার আমরা খেয়েছিলাম, কয়টা বই পড়েছি কিংবা কয় প্যাকেট সিগারেট আমরা পুড়িয়েছি। হিসাব মিলতো না। জীবনে কিছু জিনিস আছে যার হিসাবে সবসময় গোলমাল থাকে। উনিশ এবং বিশের মাঝখানে গিয়ে ক্ল্যাশ করে। মেলে না। আমােেদর শেষ ফাইনাল টার্মের আগে আগেই আমাদের ভেতর কিছু একটা কাজ করা বন্ধ কওে দেয়। আমরা দুজনে মিলে অনেক খুঁজি কিন্তু সমস্যাটা ধরতে পারি না। আমাদেও ভেতর সবসময় ঝামেলা লেগেই থাকতো। দিনের পর দিন আমরা কথা বলতাম না। ভাবতাম, সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী। একটা মিথ্যা অপবাদ দেওয়া শুরু করি নিজেকে নিজে। দীপা একশো ছেলের সঙ্গে রাতে ঘুমালেও আমি সকালে ওঠে বলতে পারবো তার সাথে কারোরই সেক্স হয়নি। সেই বিশ্বাস আমার ছিল। একটু সেকেলে আদর্শ তখনো আমাদেও ভেতর বেঁচেছিল। কিন্তু দীপা সরে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে। একদিন আমাকে ফোন করে বলে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীওে যেতে ইচ্ছে করছে তার খুব। তখন আমি বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রে। তাকে বললাম, তুমি কই?
আমি শ্যামলী, বলেছিল সে।
কি করবা এখন? আমি আসবো নাকি তুমি আসতে পারবা?
সমস্যা নেই রবি, আমি আসতেসি।
দুপুরের দিকে আমরা বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ বুড়িগঙ্গার কালোজলের দিকে তাকিয়ে থাকি। ছোট ছোট কিছু নৌকা ফটফট শব্দ করে দ্রুত ছুটে চলছে, কিছু কিছু নৌকায় ইঞ্জিন নেই। ঢেউয়ের ধাক্কায় আপনা-আপনিই ভেসে চলছে। মাঝি দাঁড়িয়ে আছে। প্রচুর বাতাসে তার লুঙ্গির একদিক গায়ে লেপ্টে যায়। এদের কোনো প্রেমিকা নেই দীপা? বলেছিলাম আমিÑ কিংবা বউ? দীপা পৃথবীতে ফিরে আসে যেন। কিছু একটা নিয়ে হিসাব মেলায়। কিন্তু তার মনে হয় কথা বলতে ইচ্ছে করছে না বা যেটা বলতে হবে সেটা বলতে তার সংকোচ কাজ করছে। দীপা দেখ, বলেছিলাম আমি, ঐ যে দূরের নৌকা থেকে গান ভেসে আসছে, শুনছো? তার গান তো কেউই শুনছে না, তাহলে সে কেন গান করছে একা একা?
আমাদের সবকিছুই একেকটা গান রবি, মানুষের দুঃখকে আসলে কোনভাবেই সহজে সে বলতে পারে না, বলতে পারার সহজপথটা হচ্ছে চিৎকার করে গান করা, ‘আমার তোমাকে খুব মনে পড়ছে প্রেমিকা’, এটা সে চিৎকার করে বলতে পারবে?
পারবে কিন্তু একটু লজ্জা লাগতে পারে, বলেই একটু হাসলাম আমি।
সেটাই, সে তার সবকিছু ফেলে কোথাকার কোন্ নদীতে নৌকা ভাসাচ্ছে, তারও তো প্রেমিকার কথা মনে পড়তে পারে। তখন সে তার মনে পড়াটুকুর অ্যাবস্ট্রকট যন্ত্রণাকে শব্দে কনভার্ট করে গান বানিয়ে চিৎকার করে বলতে পারে,
‘যহন বন্ধু জ্বলবে রে প্রাণ আমারি নাম লইও,
আমার দেওয়া মালার সনে দুঃখের কথা কইও!’
কী সাংঘাতিক দুটো লাইন দীপা! মাঝির দিয়ে আসা মালাকে সে সব দুঃখ বলছে, ইমাজিন করো, কি মধুর বেদনাময় একটা দৃশ্য?
হুম, আচ্ছা রবি, আমি যদি আর কাউকে ভালোবেসে ফেলি তুমি কি কষ্ট পাবে?
তুমি কি কাউকে ভালোবেসে ফেলছো?
আমার প্রশ্নের উত্তরে তুমি প্রশ্ন করছো কেন?
না, এমনিতেই বললাম, বলেই মাটির দিকে তাকিয়ে থাকি।
রবীন্দ্রনাথের ঐ কবিতাটা পড়ছিলা?
কোন কবিতা?
দীপা বুকের ওপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে গলায় পেঁচায়। আমার সেদিকে চোখ যায়। আমার মনে হয়, আমি যদি বলি, সে আর কাউকে ভালোবেসে ফেললে আমার কষ্ট হবে খুব, আমার জীবন পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে পড়বে, তাহলে আমার সেইসব দুঃখরা কখনোই তার এই সুগঠিত স্তনের নিচে দামি ব্রেসিয়ার ভেদ করে বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারবে না। তাই চুপচাপ নদীর দিকে তাকিয়ে থাকি।
হঠাৎ শুনতে পাই দীপা গুনগুন করে গাইছে,
‘একদা কোন বেলা শেষে
মলিন রবি করুণ হেসে
শেষ বিদায়ের চাওয়া আমার মুখের পানে চাবে।’
দীপা, আমাদের কি এইই শেষ দেখা? দীপা সেদিন উল্টর দেয়নি। ক্যাম্পাসে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলা শুরু করেছিল। রফিকের সাথে প্রায়ই দেখতাম। রফিক তখন সিজোরা নামের একটা ব্যান্ডে গান করতো। ক্যাম্পাসে মাদল আসলে তাদের সাথে লিড বাজাতো। সেখানে উৎসাহী দীপা গলা ছেড়ে গাইতো,
‘এই বন যতদূর ঠিক ততোদূর আমার বাড়ি… ’
দীপার সাথে দীর্ঘদিন আমার কথা হয়নি। মাস্টার্সে জাহাঙ্গীরনগরে আর ছিলাম না। দীপাও ফরিদপুর চলে যায়।
অনেক পরে রফিক বলেছিল তার সাথে দীপার স্্েরফ বন্ধ্ত্বু ছিল। রফিক মিথ্যা বলতে জানতো না। আমার খুবই কাছের বন্ধু ছিল সে। হঠাৎ একদিন সে সুইসাইড করে বসে। এমন হাসিখুশি একটা জোকবক্স মানুষের কাছে ঠিক কোন্ কারণে জীবনটা অর্থহীন হয়ে পড়েছিল ভাবতে গিয়ে কোনো উত্তর পাই না। তার শেষকৃত্যে দীপাও আসে। একফোঁটা কাঁদেনি সে। শুধু চুপচাপ তাকিয়ে ছিল রফিকের শীতল মুখের দিকে।
জীবনটা পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে যায় আমার। এই নিঃসঙ্গতা কাটাতে আমি ড্রিংক-এর পরিমাণ বাড়িয়ে দিই। পরপর কতগুলো গল্প লিখি, যেগুলো বেশ কিছু মানুষের হাতে পৌঁছে যায়।
সাভারে একটা স্কুলে পড়ানো শুরু করি। দীপাকে ভুলে যাওয়ার জন্য যতগুলো পথ ছিল, সব পথেই আমি হেঁটেছিলাম। কাজ হয়নি। মাঝখান থেকে তিনটা বছর হারিয়ে গেল। তিনটা বছর আমি পাগলের মতো এদিক-সেদিক ঘুরেছিলাম। ঢাকা শহর খুবই ছোট, দীপাকে প্রায়ই দেখতাম। নতুন নতুন মানুষের সাথে দেখতাম তাকে, আমাদেও সেইসব পরিচিত জায়গায়ই তার সাথে দেখা হতো বেশি। সে না চেনার মতো করে তাকাতো না। হাসতে হাসতে নীলক্ষেত থেকে বইয়ের দোকানদারের সাথে দামাদামি করতো, মসেই হাসি দেখে আমার মনে হতো, এই সরল হাসিরটার জন্য এই জীবনে আমি সবকিছু করতে পারি!
ঠিক কওে ফেলি এদেশে আর আমার থাকা হবে না। আমার জন্য বরাদ্দ বাতাস ফুরিয়ে গেছে। আর কিছুদিন থাকলেই আমি মরে যাব। বাসায় বলতেই আমার ফিনল্যান্ডে থাকা চাচার কাছে বাবা আনন্দে ফোন করে বসে, বলে, আমাকে ফোন করে সবকিছু ঠিক করে নিতে।
পড়েছি নৃবিজ্ঞানে। বড় হয়ে অনেক কিছু হবো, সেরকম কোনো স্বপ্ন ছিল না আমার। ছোটখাটো একটা কাজ করবো, সেখান থেকে আসা পয়সা নিয়েই বেঁচে থাকবো। এর চেয়ে বেশি কিছু চাইনি। কিন্তু আমার বাবা চায় আমি দুনিয়া বদলে ফেলি। লক্ষ লক্ষ টাকা আমার নামে জমা থাক। আমার সরল বাবার দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিই, টাইম ইস ওভার। দীপা নামের মানুষটাকে বিদায় জানানোর সময় এসে গেছে।
ফিনল্যান্ড যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু করার প্রাথমিক স্টেজে আমি আইলটেলস পরীক্ষার জন্য ভর্তি হই। সেখানে গিয়ে আবার দেখা হয় দীপার সাথে! লাইফ ইস এ সার্কাল, সবকিছু ফিরে ফিরে আসে!
ইংরেজির মারপ্যাঁচ বোঝার চেয়েও আমি বেশি বোঝার চেষ্টা করছিলাম দীপাকে। শীতে জুবুথুবু হয়ে থাকা বিড়ালের মতো চুপচাপ থাকতো সে। আমি একদিন বললাম, কতদিন পর দেখলাম তোমাকে।
একটা নিশ্বাস ফেলার জন্য বেশ কিছু বাতাস ফুসফুসে ঢুকিয়ে সেটা ফুশশ করে ছাড়ে সে, তারপর বলেছিল, হ্যাঁ, তিন বছর!
মাঝখানে তোমাকে অনেকবার দেখেছিলাম, রনি ভাইয়ের কফিশপে কফির সামনে বসে থাকতে, সেন্ট্রাল ফিল্ডে, নীলক্ষেত, বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রে। কিছুদিন আগে শেষবার দেখেছিলাম এলিফ্যান্ট রোডে।
দেখেছো তাহলে? কথাগুলো খুব অদ্ভুত শুনালো। যেন আঁটকে যাচ্ছে, বের হতে চাচ্ছে না।
দীপা খুবই ভীতু একটা মেয়ে। চার বছরের প্রেমে তাকে খুব সম্ভবত দুবার চুমু খেয়েছিলাম। তখন আমরা তৃতীয়বর্ষে। অঞ্জন দত্ত এসেছিল সেবার ক্যাম্পাসে। পৃথিবী থেকে খুঁজেটুজে দশজন ডাই-হার্ড ফ্যান বের করলে সেখানে দীপাও থাকবে।
সেদিন দীপা একটা লাল শাড়ি পরে এসেছিল। অদ্ভুত একটা রঙের স্লিভলেস ব্লাউজ। রঙটা এমন যে, আসলে সেই রঙটা আপনার জন্য মনে রাখা খুবই কষ্টের হবে। কাঁচা কলার মতো হালকা সবুজ একটা পাথরের রকেট পরেছিল। একটু লুজ সাইজের ব্রা পরেছিল বলে রকেটের পাথরটা বুকের গিরিখাতে লুকিয়েছিল।
আমরা সেলিম আলদীন মঞ্চে বসি। সন্ধ্যা পেরিয়ে চারপাশ অদ্ভুত হিম হয়েছিল। চাঁদের আলোয় চারপাশের সবকিছু ডুবে যায়। অঞ্জন দা তখনো স্টেজে আসেননি। ফিনফিন বাতাসে আমার ফতুয়ার ভেতর ভিজে যাওয়া ঘাম শুকিয়ে একটু আরাম লাগে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি দীপাকে চুমু খাই। যেন ফুরিয়ে যাওয়া জীবনটাকে নতুন করে প্রাণ দিচ্ছিলাম।
কোন্ দেশে যাবা? বলেছিল দীপা।
যেখানে তুমি থাকবে না!
দীপার চেহেরাটা কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে যায়। একটা বেলুন ফেটে তার সবটুকু বাতাস বের হয়ে যাওয়ার মতো চুপসে গেল সে। ঠোঁট নড়ছে কিন্তু কোনো কথা বের হচ্ছে না। শেষে যোগ করলাম, তুমি কই যাবা?
ইংল্যান্ড। ওখানে একটা ইউনিভার্সিটি থেকে স্কোলারশিপ দেয় প্রতি বছর। একটা নেওয়ার ইচ্ছে আছে, যদি পারি আরকি।
ফার্মগেটে ‘ইজি টু গো’ কোচিং সেন্টারের নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলি আমরা। দীপা অপরাধ স্বীকার করার মতো করে বলেছিল, তুমি কই যাচ্ছ বললা না যে?
সেটা তুমি জানো।
ফিনল্যান্ড?
হ্যাঁ।
আবার সবকিছু নীরব হয়ে যায়। সেদিন আমার আবার আমার বন্ধু রফিকের শেষকৃত্যের কথা মনে পড়ে। সেদিন সবকিছু যেভাবে চুপচাপ ছিল, সেই সময়টা যেন আবার ফিরে আসে।
গল্প লিখছো দেখি। কিছুদিন আগেও একটা লেখা পড়েছিলাম তোমার সমকালে। খুব সম্ভবত নাম ছিল ক্লান্ত হৃদয়ের করুণ মিনতি। গল্পটা প্রথমবার পড়ার পর কয়েকবার পড়ি, মনে হচ্ছিল জাগতিক বিষণ্নতাকে তুমি একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এনে আটকে দিয়েছো। খুব কষ্ট হয়েছিল পড়তে। তোমার গল্পগুলো এতো বিষণ্ন কেন, রবি?
এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর থাকে না। একটু হেসে সিগারেট জ্বালিয়ে ধোঁয়াগুলোকে রিং বানিয়ে ছাড়তে ছাড়তে বলেছিলাম, ‘সূর্য তুমি সাথী’ বইটা পড়ছিলা, না?
সামান্য মাথা নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ। কিন্তু তোমার ঐ গল্পটা পড়ার পর আমার সবকিছু এলেমেলো হয়ে যায়। এই ঢাকা শহরে তন্ন-তন্ন করে তোমার দুটো পা আমি খুঁজেছিলাম, ক্ষমা চাওয়ার জন্য। তাই এখানে আসা। সেদিন আর ক্লাসে যাইনি। একটা কফিশপে গিয়ে বসি আমরা। সে পুরোনো সুরে অর্ডার দিয়ে বামহাতের মুঠে ডান হাতের চারটা আঙুল পুরে নিয়ে বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে সেগুলো ঘষতে থাকে। খুব আপসেট দেখাচ্ছিল ওকে। বলেছিলাম, কী হয়েছে?
কিছু না, আমাকে কি একটু আবার সেই বুড়িগঙ্গা নদীতে নিতে পারবা?
দোতলার বিশাল কাচের দেওয়াল দিয়ে বাইরে তাকাই। ভীষণ রো দ। কতগুলো গাড়ি সেখানে আটকে আছে। দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতে পা তুলে একটা কুকুর বিষাক্ত তরল নিষ্কাশিত করে আবার হাঁটতে থাকে। দুই আর দুই যোগ করলে কত হতে পাওে, সেই সহজ সমাধানটুকু করার বোধশক্তি আমার ভেতর সেদিন ছিল না। পাগলের মতো শুধু বলেছিলাম, অবশ্যই পারবো দীপা।
আমাকে মাঝপথে ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে একটিবারও প্রশ্ন করিনি আমি। তাকে রদখা পর সবকিছু ভুলে যাই আমি। আমার শরীর আর মন পুরোপুরি অবশ হয়ে যায়। আসলে তাকে ডিনাই করার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি আমার ছিল না। শেষের দিকে খুবই ডিপ্রেসিভ একটা মানুষে পরিণত হয় সে। তাকে সেদিন দেখার পর কেমন জানি লাগে আমার।
কোথায় জানি পড়েছিলাম, খুব সম্ভবত কোনো আর্টিকেল হবে, ভালোবেসে ফেললে সবারই শরীরের ভেতরে একধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। যাকে ভালোবেসে ফেলেছেন, তাকে দেখলে বুকের ভেতর এক অদ্ভুত চাপ অনুভব হয়। এ অনুভূতিকেই ইংরেজিতে সুন্দর একটা ফ্রেজে বলা হয়, ‘বাটার ফ্লাইস ইন স্টোমাক’। এ অনুভূতির কারণ অবশ্য কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেনি। আমিও পারিনি। কারণ, আমি ঠিকই ফিনল্যান্ড চলে আসি। কিন্তু দীপার সাথে আর কখনোই কথা হয়নি।
সেদিন বুড়িগঙ্গার তীরেই আমরা আমাদেও শেষসন্ধ্যা কাটিয়ে ফিরে আসি। একটার পর একটা সিগারেট পুড়িয়ে পুরো আকাশ ধোঁয়ায় কালো কওে ফেলার প্রতিযোগিতায় নামি। ওর দুটো চোখ ছলছল করছিল। কতগুলো কথা সেখানে জমে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, কিন্তু দীপা বলেনি। এরপর ক্লাসে কয়েক মাস এসেছিল। তারপর হাওয়া হয়ে যায় চিরতরে।
মনে হচ্ছে সবকিছু গতকাল ঘটেছে কিন্তু তখন আমার বয়স ছিল সাতাশ আর আজ আমার বয়স ছত্রিশ! মাঝখানে নয় বছরের দূরত্ব। চাইলেও একটা বাসে চেপে বসে এক ঘণ্টায় ওর কাছে যেতে পারি না!