বাউল ধর্মতত্ত্ব ও গান

জসিম উদ্দিন মনছুরি »

এক কালে নাথপন্থা ও সহজিয়া মতের প্রাদুর্ভাব ছিলো বাংলায়। এ দুই সম্প্রদায়ের বহু লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু তাদের বদ্ধমূল ধারণা, বিশ্বাস ও সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও তারা নিজেদের পুরানো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে। অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে মুসলমান মাধববিবি ও আউল চাঁদই এ মতের প্রবর্তক এবং মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দ- পুত্র বীরভদ্রই বাউল মত জনপ্রিয় করেন। বাউলরা সাধারণত অশিক্ষিত। এজন্য তাদের কোনো লিখিত শাস্ত্র নেই এবং তাদের মতবাদ এর কালিক কিংবা দার্শনিক পরিচিতি তারা দিতে পারে না। সমাজের নিচের তলার লোকের ধর্ম বলে বাউল মতে শিক্ষিত লোকের কৌতূহল জন্মায়নি। রবীন্দ্রনাথই প্রথম এদের প্রতি শিক্ষিত লোকদের উৎসুক করে তোলেন। মনে করা হয় বাউল মত মূলত প্রাচীন ভারতীয় তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও মুসলিম প্রভাবে তথা সূফী মতের প্রত্যক্ষ সংযোগে এর উদ্ভব। মুসলিম বিজয়ের পর হিন্দু- মুসলমানের বিপরীতমুখী ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘর্ষে প্রথমে দক্ষিণ ভারতে পরে উত্তর ভারতে এবং সর্বশেষ বাংলাদেশে হিন্দু সমাজে এ মত আলোড়ন সৃষ্টি করে। আলোড়নের বাহ্যরূপ ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রয়াস। হিন্দুর মায়াবাদ, তজ্জাত, ভক্তিবাদ ও সুফীতত্ত্বই এসব আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছে। দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদ। উত্তর ভারতে সন্তধর্ম এবং বাংলায় বৈষ্ণব ও বাউল মতবাদ সুফিমতের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল। বাউল নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মতভেদ রয়েছে। এ নামটি উক্ত সম্প্রদায়ের স্বপ্রদত্ত নাম নয়। ১৫ শতকের শেষ পাদে শ্রীকৃষ্ণবিজয় এবং ১৬ শতকের শেষপাদের চৈতন্যচরিতামৃতে ক্ষ্যাপা ও বাহ্যজ্ঞানহীন অর্থে বাউল শব্দের আদি প্রয়োগ দেখা যায়। রাঢ় অঞ্চলে এখনো বাউলকে ক্ষ্যাপা বলে। কেউ বলেন বাউল শব্দটা আউল বা এলোমেলো, বিশৃঙ্খল,পাগল থেকে উৎপত্তি হয়েছে।
জীবাত্মা-পরমাত্মারই অংশ। জীবাত্মার মধ্যে পরমাত্মার স্থিতি। কাজেই আপনার আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরিচয় খোদা প্রাপ্তির উপায়। তাই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির সাধন বাউলদের ব্রত। এদের আদর্শ হচ্ছে দার্শনিক সক্রেটিসের ভাষায়-কহড়বিঃয ঃযুংবষভ নিজেকে চেনো। গীতার ভাষায়- আত্মানং বিদ্ধি, অর্থাৎ নিজেকে চেনো। হাদিসের ভাষায়- মন আরাফা নাফসাহু ফক্বাদ আরাফা রব্বাহু-অর্থাৎ যে নিজেকে চিনেছে সে মহান প্রভুকে জেনেছে। জীবনের পরম ও চরম সাধনা হচ্ছে খোদাকে চেনা। বাউলের রূপক অভিব্যক্তিতে এ পরমাত্মা হচ্ছে: মনের মানুষ, অটল মানুষ, অধর মানুষ, মানুষ রতন, মনমনুরা ও অচিন পাখি, আলখসাই। বাউল রচনা সাধারণত রূপকের আবরণে আচ্ছাদিত‌। সেই রূপক দেহাধায়, বাহ্যবস্তু ও ব্যবহারিক জীবনের নানা কর্ম ও কর্ম প্রচেষ্টা থেকে সংগৃহীত। মোটামুটিভাবে ১৭০০ শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকে বাউল মতের উন্মেষ। আর ১৯ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মাধ্যমে এর পরিপূর্ণ তাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক বিকাশ ঘটে।
বাউল সাধারণত দুই প্রকার : গৃহী ও বৈরাগী। বর্তমানে এরা বহু উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত। যথা- হজরতী, গোবরাই, পাগল নাথী, খুশীবিশ্বাসী, সাহেবধনী, জিকির ফকির, আউল, বাউল, ন্যাড়া, বলরামি, শম্ভুচাদী, রামবল্লভী প্রভৃতি। মুসলমান বাউলেরা সাধারণত বেশরা ফকির, নেড়ার ফকির, বেদাতি ফকির, মুর্শিদপন্থী, মারফতি ফকির নামে পরিচিত। বৈষ্ণবেরা একান্তভাবে প্রেমিক ও প্রেম সাধক। বাউলেরা তাত্ত্বিক। বৈষ্ণবরা পার্থিব জীবন ব্যাপারে উদাসীন। বাউলেরা কিন্তু জীবন, সমাজ ও পরিবেশ সচেতন। ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রীতির সুউচ্চমিনারে বসে বাউলেরা সাধনা করে। বাউল গান একাধারে ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, ভজন, সংগীত ও সাহিত্য। বাউল কবিদের মধ্যে লালন, মদন ,পাগলা কানাই, ঈশান, গঙ্গারাম, দীনু, পাঞ্জুশাহ, যাদুবিন্দু প্রভৃতি প্রধান।
ধর্ম সাধনা প্রসঙ্গে বাউল বলেন:
সখি গো, জন্ম মৃত্যু যাহার নাই
তাহার সঙ্গে প্রেম গো চাই।
উপাসনা নাই গো তার
দেহের সাধন সর্বসার।
তীর্থব্রত যার জন্য
এ দেহে তার সব মিলে।
কথিত আছে লালন ফকির যুবক বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়। বসন্ত রোগকে অকল্যাণের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। যাদের ফ্যামিলিতে বসন্তরোগ হয় সেই ফ্যামিলিকে অচ্ছুত করে সমাজচ্যুত করা হতো।
প্রথানুযায়ী লালন ফকিরকে বাঁশের ভেলায় নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। নিঃসন্তান মুসলিম দম্পতি তাকে পেয়ে সেবাশুশ্রূষায় সুস্থ করে লালন-পালন করেন। সুস্থ হয়ে লালন পরিবারে ফিরে এলে মুসলমানের ঘরে অন্নজল পান করায় তাকে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হয়। ফলে তিনি ধর্মের প্রতি বিরাগভাজন হন। সমাজ সংসার থেকে দূরে গিয়ে তিনি গড়ে তোলেন একটি আখড়া। সেখানে তিনি কোন ধর্মের প্রচার-প্রসার না করে মানব ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। তার সাথে যুক্ত হয় আরো অনেকে। তারা সংগীতচর্চা ও বাউলমত প্রচার করতে থাকেন। বাউল মতে নারী পুরুষের একত্রে বসবাস দূষনীয় নয়। বরং সাধনার জন্য পুরুষের সাধন সঙ্গী হিসেবে নারীর প্রয়োজন। অন্যথায় সাধনা পূর্ণ হয় না। তখন থেকে তারা জাত ধর্ম ছুঁড়ে ফেলে মানব ধর্মের গান রচনা করতে থাকেন। বাউলরা সাধারণত অশিক্ষিত হওয়ায় গ্রামেগঞ্জে রাস্তার ধারে এক তারা হাতে গান গাইতেন। পালা গানের আসর হতো। দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গানের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গানের আসরকে জমিয়ে তোলেন। আগেই বলা হয়েছে তারা ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে গিয়ে বাউল মতের প্রচার প্রসারে সংগীত চর্চায় মত্ত থাকেন। জাতভেদ ও ধর্মের উর্ধ্বে তাদের মতবাদ প্রচার করেন। সাধারণত বাউলরা স্বল্প কিংবা অশিক্ষিত হওয়ায় তারা গানের বাইরে ধর্ম কর্মের তেমন একটা জ্ঞান রাখে না। বর্তমানে প্রায় ৫ হাজারেরও অধিক বাউল শিল্পী রয়েছে।
বাউলদের মধ্যে লালন শাহের নাম খুবই মশহুর। লালন শাহের মাধ্যমে মুলত বাউল গান সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে লালন সাঁইয়ের গান উপমহাদেশসহ সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে লালনের গান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে। রবীন্দ্রনাথ লালনের গান সংগ্রহ করে ১৯২২ সালে ভারতীয় পত্রিকার হারামনি শাখায় চারভাগে ২০টি গান প্রকাশ করেন। লালন সাঁইয়ের বাউল গানে উৎসাহী ও অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেকে রবীন্দ্র-বাউল হিসেবে পরিচয় দিতেন স্বয়ং বিশ্বকবি। লালনের গানের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীতে উপমহাদেশে অসংখ্য বাউলের আবির্ভাব ঘটে, যারা পরবর্তীতে বেশ ভালভাবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বাউল গানকে সর্বোচ্চ অবস্থানে নিয়ে যেতে লালন সাঁই’র ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তার মৃত্যুর ১২৫ বছর পরও বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি লালন সাঁইয়ের গানের চেতনায়। শহরে, গ্রামে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে বাউলসংগীত। সব ধরনের শ্রোতাই মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করে বাউল গান। এ গানের অসম্ভব জনপ্রিয়তার পেছনে আছে এর সর্বজনীনতা, গভীর মানবিকতা বোধ। ইউনেস্কো ২০০৫ সালে বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। ইউনেস্কো যে স্বীকৃতি বাউল গানকে দিয়েছে, তার অধিকাংশ কৃতিত্বই লালন সাঁইয়ের। মানুষ লালনের গান শুনেই বাউল গান নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে বেশি। তরুণ গবেষক সাইমন জাকারিয়ার মতে এই স্বীকৃতির ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলার বাউল গানের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। এর ফলে বাউল গানের সংরক্ষণ ও প্রসারেরও সুযোগ তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা নিয়ে এ ব্যাপারে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, ওই ঘোষণার পর ইউনেসকো বাউল গানের বাণী ও সুর সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের জন্য আর্থিক অনুদান প্রদান করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পকলা একাডেমি একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০০৮ সালের দিকে ওই প্রকল্পের আওতায় কুষ্টিয়া অঞ্চলে ফিল্ড ওয়ার্কের মাধ্যমে বাউল গানের বাণী ও সুর সংগ্রহের কাজ চলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫০০ বাউল গান নিয়ে ‘বাউলসংগীত’ নামে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়, যার মধ্যে ১০০টি গানের ইংরেজি অনুবাদ এবং দেড় শ গানের স্বরলিপি যুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় বাউলদের কণ্ঠে অবিকৃত সুরে গাওয়া পঞ্চাশটি বাউল গান সিডিতে ধারণ করে ওই গ্রন্থের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সাইমন জাকারিয়ার মতে, বাংলার অমূল্য সম্পদ বাউল গান সংরক্ষণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বাউলশিল্পী অধ্যুষিত অঞ্চল সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, নাটোর প্রভৃতি অঞ্চলে ফিল্ড ওয়ার্ক শুরু করা উচিত। না হলে কালের গর্ভে অনেক গান এবং গানের সুর হারিয়ে যাবে। বাউল গানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ইউনেস্কোর সনদপত্রটি সংরক্ষিত হচ্ছে বাংলা একাডেমি জাতীয় লেখক ও সাহিত্য জাদুঘরে। কয়েকটি বাউল গান এখনো তরুণ ও বৃদ্ধসহ সব বয়সের মানুষের মনে দোলা দেয়। আবদুর রহমান বয়াতীর যুগলবন্দীতে ‘মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি/কোন মিস্তরী বানাইয়াছে’ – তারুণ্যের একনম্বর পছন্দের তালিকায় ছিল বেশ ক’ মাস। বাউল গানের সুন্দরীতমা চাঁদ ঢাকা পড়ে রইল অপসংস্কৃতির কালো মেঘে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছে বেশ ক’বছর। তবে যে নতুন রূপে বাউল গানের প্রকাশ ঘটল একবিংশ শতাব্দীতে তার সঙ্গে তুলনা চলেনা আগেকার কোন সময়েরই।
মানবকল্যাণ কামনায় সবচেয়ে বেশি সুর ধ্বনিত হয়েছে মরমি সাধক লালনের গানে। লালনের সাম্যবাদী চিন্তাই আজকের উদার মানবতাবাদ। লালন বলেন, ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে/যেদিন হিন্দু মুসলমান/বৌদ্ধ খ্রিস্টান/জাতি গোত্র নাহি রবে।’ বস্তুত উনিশ শতকে লালনের গান তার সর্বজনীন আবেদনের কারণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লালনের কারণেই হিন্দু, মুসলমান সম্প্রদায়ের দেহতত্ত্ববাদীরা সব বিভেদ ভুলে যুত সাধনায় মিলিত হন। শিষ্য-ভক্তদের মাধ্যমে লালনের গান প্রচার ও প্রসার লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালনের কথা প্রচার করেন বহির্বিশ্বে। লালনের পর পাণ্ডু শাহ, দুদ্দু শাহ, ভোলা শাহ, পাগলা কানাই, রাধারমণ, কাঙাল হরিনাথ, হাছন রাজা, অতুল প্রসাদ, বিজয় সরকার, দ্বিজদাস, জালাল খাঁ, উকিল মুন্সী, রশিদ উদ্দিন, শাহ আব্দুল করিম বাউল গান গেয়ে এই গানকে সর্বশ্রেণির মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ কবিও বাউলের মাধ্যমে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত সংগীতের ধারাটি আরো পুষ্ট হয়।

লালনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গান:
“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন কয় জাতের কি রূপ দেখলাম না এ নজরে।।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান,
নারী লোকের কি হয় বিধান?
বামণ চিনি পৈতার প্রমাণ
রমনী চিনি কি ধরে।।”

জগৎ শক্তিতে ভুলালে সাঁই ।
ভক্তি দাও হে যা’তে চরণ পাই।।
রাঙ্গা চরণ দেখবো ব’লে
বাঞ্ছা সদায় হৃদ-কমলে,
তোমার নামের মিঠায় মন মজেছে,
রূপ কেমন তাই দেখতে চাই।।

ভক্তির দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই।
হিন্দু কি যবন ব’লে
তার কাছে জাতের বিচার নাই ।।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।।
আট-কুঠুরী নয় দরজা আঁটা ,
মধ্যে মধ্যে ঝলকা কাটা,
তার উপর আছে সদর কোঠা-
আয়না মহল তায়।।

আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
আমার বাড়ির কাছে আরশি নগর,
এক পড়শী বসত করে।
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।।

এমন মানব জনম আর কি হবে।
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।।
অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই,
শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই,
সব দেবতাগণ
করে আরাধন
জন্ম নিতে মানবে।।

‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’, ‘কে বোঝে সাঁইয়ের লীলাখেলা’, ‘জাত গেলো জাত গেলো বলে’ , ‘মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষের সনে’। গানগুলি এখনো আবহমান কাল ধরে বাংলার প্রতিটি জনপদেই সমানভাবে জনপ্রিয়।বাউল গানের কিংবদন্তি শাহ আবদুল করিমের গান কথা বলে ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি তার গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পাঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে। তিনি আধ্যাত্নিক ও বাউল গানের দীক্ষা লাভ করেছেন কামাল উদ্দিন, সাধক রশিদ উদ্দিন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকশ এর কাছ থেকে। তিনি শরীয়তী, মারফতি, নবুয়ত, বেলায়া সহ সবধরনের বাউল গানে সুর কণ্ঠ দিয়েছেন। কিছু কিছু বাউল গান ধর্মীয় অনুভূতির সাথে সাংঘর্ষিক হলেও গ্রাম বাংলার ইতিহাস,ঐতিহ্য, রীতিনীতি, সাধনা ইত্যাদির চিত্র বাউল গানের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। বাউল গান এ যেমন রয়েছে ধর্মতত্ত্ব , সাধনা, জাতিভেদের উর্ধ্বে ওঠে সাম্যের অনিন্দ্য সুন্দর বয়ান। গ্রামের স্বল্প কিংবা অশিক্ষিত লোকদের রচনা হলেও এই গানগুলির সাহিত্যিক মূল্য অনিবার্য হয়ে ঐঠেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাই, বাউল গান থেকে স্বদেশের চিত্তের একটা ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যায়। এ জিনিস হিন্দু মুসলমান উভয়েরই একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি।এই মিলনে গান জেগেছে এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু মুসলমানের কন্ঠ মিলেছে।