ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখেও ভয় পায়। আমরা নগরবাসীর দশাও হয়েছে তাই। অন্তত ত্রিশ বছর ধরে চট্টগ্রামের দুঃখ বলে অভিহিত চাক্তাইখাল নিয়ে অনেক পরিকল্পনা দেখছি। অনেক অর্থ বরাদ্দ এবং তা হরিলুটের দৃশ্যও দেখছি। দেখছি কীভাবে খালগুলো মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। খালগুলো নালায় পরিণত হচ্ছে আর নালাগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দেখছি মানবসৃষ্ট এই বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের জন্য সরকারি উদ্যোগ, বিশেষজ্ঞদের মতামত, ক্ষমতাসীনদের দৌড়ঝাঁপ আর জনগণের টাকার অপচয়। এ পর্যন্ত কত বিশেষজ্ঞরা এলেন আর গেলেন, কত পরিকল্পনা প্রণীত হলো আর পরিত্যক্ত হলো, কত উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো আর ব্যর্থ হলো। কত শত কোটি টাকা অপচয় হলো, ভাগাভাগী হলো কিন্তু চট্টগ্রামের দুঃখ চাক্তাই খাল আগের অবস্থায় ফিরে এলো না, দখল ও দূষণমুক্ত হলো না। ফিরে পেল না তার ধারণ সক্ষমতা। ডান পাড়ের মাটি তুলে বাম পাড়ে জমা করা হলো। বর্ষা বা বৃষ্টিতে তা আবার খালে নেমে এলো। খালের তলদেশ পাকা করার নামে কোটি কোটি টাকা শ্রাদ্ধ করা হলো কিন্তু খালের প্রকৃত সংস্কার কিছুই হলো না।
সবাই জলাবদ্ধতা দূরীকরণের প্রতিশ্রুতি দেন কিন্তু কার্যত সফল হন না। কর্তা বদল হন। তার সাথে কিছু পরিকল্পনা বদল হয়। অর্থ বরাদ্দ হয় কিন্তু বাস্তবে কোনো সুফল পায় না নগরবাসী।
শহরের অন্তত অর্ধেক জায়গা বছরের সাত থেকে আট মাস জলাবদ্ধতা ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। আধঘণ্টার বৃষ্টিতে পানিবন্দি হয়ে পড়ছে শহরের অধিকাংশ এলাকা। এই সমস্যা উত্তরণের জন্য মেগা প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। অনুসন্ধানে কোনো বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পন্থা বের করতেও বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই। অংকটি বেশ সোজা। পানিকে তার গন্তব্যে যাওয়ার রাস্তা করে দেওয়া। সে কোথাও জমবে না, রাস্তা ডোবাবে না, কারো বাড়ি ঘর ডোবাবে না।
নগরায়ণের ফলে জলাশয় ও নিম্নভূমি যেখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকার সুযোগ ছিল, তা ভরাট করে দালানকোটা তৈরি হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি জমার ক্ষেত্র সংকীর্ণ হয়েছে। নগরায়নের ফলে সড়ক প্রশস্ত হয়েছে, খাল ও নালার ওপর সড়ক ও বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হয়েছে ফলে খাল ও নালাগুলো ভরাট ও সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। বক্স কালভার্ট করে খালগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে। খালের দু’পাশে অবৈধ দখলকারীরা স্থাপনা নির্মাণ করে খালকে সরু করে তুলেছে। অর্থাৎ নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু পানি চলাচলের পথ দিন দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতম হয়েছে।
দখল দূষণের পরও বর্তমানে যে খাল ও নালাগুলো আছে তা শুধু পরিষ্কার রাখলেও জলজট ৫০ শতাংশের বেশি কমে যেত। একটি নালা বা খালও নেই শহরে যেটি পরিষ্কার আছে এবং তার ধারণ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার হয়। সবক’টি নালা ও খাল বিভিন্ন বর্জ্যে ভরাট হয়ে আছে। শুধু এই আবর্জনা তুলে খাল ও নালাগুলোর ধারণ ক্ষমতা ফিরিয়ে আনলেই জলজটের সমস্যা কমে যাবে। আর এই কাজটি বর্ষার আগে আগে নিয়মিত করলে হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের প্রয়োজন হতো না। খালগুলোকে আবর্জনার ভাগাড় বানিয়ে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করতে যারা প্রতি বছর সড়ক উঁচু করে করে আশেপাশের বসবাসকারীদের বারোটা বাজিয়েছেন তাদের নির্বুদ্ধিতা বা অসৎ উদ্দেশ্যের নিন্দা না করে পারি না।
তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে এখন থেকেই নালা ও খালগুলো সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। এখনো যেটুক আছে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার অর্থাৎ খাল ও নালার ধারণ ক্ষমতা পূর্ণভাবে ফিরিয়ে আনুন। সড়কের পানি দ্রুত নালায়, নালার পানি খালে এবং খালের পানি নদীতে নেমে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। এই পথটুকু যেতে যে প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করার উদ্যোগটি আগে নিতে হবে। খাল এবং নালাগুলোকে পরিষ্কার রাখতে নিয়মিত ব্যবস্থা নিতে হবে। যার বাড়ির অংশের নালা ও খালে আবর্জনা পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এরমধ্যে ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’-এর মতো যুক্ত হয়েছে অরক্ষিত নালা ও খালগুলো, যেখানে পড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সুরক্ষা দেয়াল না থাকার কারণে গত কয়েকমাসে বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে শিশু যেমন আছে তরুণ-যুবক ও বয়স্করাও আছে। এসব অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর দায় সিটি করপোরেশন ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ’কে নিতে হবে।
এই দুই প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাব। অন্তত অরক্ষিত নালা ও খালের কিনারায় যেভাবে হোক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে মৃত্যুঝুঁকি কমাতে হবে।
এ মুহূর্তের সংবাদ