মুহাম্মদ শামসুল হক »
বহু প্রতিক্ষীত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আজ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত স্বপ্নের এ টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে শুভ উদ্বোধন করবেন। পতেঙ্গা প্রান্তে টানেল উদ্বোধন করার পর তিনি আনোয়ারা প্রান্তে কোরিয়ান ইপিজেড মাঠে সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন। এ উপলক্ষে প্রয়োজনীয় সাজসজ্জা ও নিরাপত্তামূলক প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। উদ্বোধনের পরদিন টানেলটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। টানেল উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে পুরো চট্টগ্রামবাসীর মনে ব্যাপক আশা-উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে সর্বস্তরের জনগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশেষ করে গত দুই মেয়াদে জনগণের আর্থ-সামাজিক ও যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে সব চাইতে বেশি জোর দিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ, সুলভ করার মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনা এবং কৃষিজ ও শিল্পপণ্যের পরিবহণ দ্রুত করার মাধ্যমে সময় সাশ্রয় করার লক্ষ্যে অনেক দীর্ঘমেয়াদী মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এরমধ্যে অন্যতম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সরকারের একটি মেগা প্রকল্প ও চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে প্রথম নির্মিত টানেল এটি। এ টানেল বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাইলফলক। সারা দেশের উন্নয়ন মেগাপ্রকল্পগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ বর্তমান সরকারের সাফল্যের ক্ষেত্রে নতুন পালক যোগ করল।
চট্টগ্রাম মহানগরকে দুভাগে বিভক্ত করেছে কর্ণফুলী নদী। নদীর উত্তর পাড় জুড়ে রয়েছে নাগরিক জীবনের কোলাহলময় বন্দর-শহর। দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে কয়েক যুগ ধরে বর্ধিষ্ণু পশ্চিম পটিয়া-হালের কর্ণফুলী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চল। চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়াসহ বান্দরবন ও কক্সবাজারের মধ্যে যোগাযোগের প্রধান সড়ক হচ্ছে আরাকান সড়ক তথা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। শহরের সঙ্গে আরাকান সড়কের সেতুবন্ধন রচনা করেছে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু এবং শতবর্ষী কর্ণফুলী রেলওয়ে সেতু। রেলওয়ে সেতুটি সম্প্রতি খুলে ফেলা হয়েছে নতুন রেলওয়ে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগরসহ চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের বর্ধিষ্ণু জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ ও শিল্প এলাকার পণ্য পরিবহণের জন্য দুটি সেতুও যথেষ্ট ছিল না। আগামী বছরগুলোতে দেশের শিল্প-বাণিজ্য, অবকাঠামো, জনসংখ্যা, কৃষি উৎপাদন ইত্যাদি নিঃসন্দেহে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। ফলে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন সড়কেও যানবাহনের চাপ বাড়বে। বর্তমান সরকারের উন্নয়ন নীতিমালার অন্যতম হচ্ছে সারা দেশে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের পাশাপাশি কেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থা সব জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং সমুদ্র-বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। চট্টগ্রাম শহরে নির্মিত হবে বে-টার্মিনাল। রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনাও। সবকিছু মিলিয়ে চীনের সাংহাই শহরের অনুকরণে কর্ণফুলীর দুই তীরের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার।
পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের প্রকল্প- প্রস্তাব গৃহীত হয় ২০১৩ সালে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ব্যাপারে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সমঝোতা চুক্তি সই হয় ২০১৪ সালে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ২০১৬ সালে যৌথভাবে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নকশাসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেল বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। টানেলের খনন কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানেলটির নির্মাণপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কম্পানি লিমিটেড কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এরমধ্যে দুই লেনবিশিষ্ট সুরঙ্গ রয়েছে দুটি। সুরঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার। টানেলের বাইরে দুই প্রান্তে রয়েছে ৫ দশমিক ৩৫০ কিলোমিটর সংযোগ সড়ক। প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা এবং প্রকল্পকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ ডিসেম্বরে। কিন্তু করোনা মহামারী পরিস্থিতির কারণে কাজ বিলম্বিত হওয়া, ভূমি অধিগ্রহণ এবং নির্মাণ সামগ্রী ও মজুরি বৃদ্ধির ফলে নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। কাজ শেষ হতেও বাড়তি সময় লাগে প্রায় ২ বছর।
এ টানেল চট্টগ্রাম নগরের সঙ্গে আনোয়ারা উপজেলার সংযোগ ঘটানোর পাশাপাশি দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, চন্দনাইশসহ বান্দরবন ও কক্সবাজারের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটাবে। প্রকল্প গ্রহণের প্রাথমিক পর্যায়ে পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী টানেলের ভেতর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজারের বেশি গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসেবে বছরে চলাচল করতে পারবে প্রায় ৬৩ লাখ গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ দৈনিক গাড়ি চলাচল ২৮ হাজার ছাড়িয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে সমীক্ষায়।
টানেলটি শুরু হয়েছে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমির কাছ থেকে। এটি নদীর তলদেশ দিয়ে আনোয়ারা উপজেলার ইউরিয়া সার কারখানা ও কর্ণফুলী সার কারখানার মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে শেষ হয়েছে। টানেলের এপার থেকে ওপারে যেতে সময় লাগবে সাড়ে তিন থেকে চার মিনিট। ইতিমধ্যে টানেলটি চালুর সমস্ত প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। টানেলের প্রবেশমুখ থেকে শুরু করে গোল চত্বর ঘিরে করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান। ভেতরে-বাইরে রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। টানেলের দু পাশে থাকছে দুটি পুলিশ ফাঁড়ি ও দুটি অগ্নিনির্বাপণ স্টেশন। টানেলের ভেতরে বসানো হয়েছে অগ্নিনির্বাপণ কাজে ব্যবহৃত বিশেষ পানির কল। উদ্বোধন উপলক্ষে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে মহড়া অনুষ্ঠানও সম্পন্ন হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল চালু হওয়ার পর শাহ আমানত সেতু এবং এ সেতুর সঙ্গে সংযুক্ত সড়কগুলোর ওপর চাপ প্রায় কমে যাবে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কক্সবাজার বান্দরবনসহ চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত গন্তব্যের গাড়িগুলোকে চট্টগ্রাম শহরের ভেতর প্রবেশ করতে হবে না। এসব গাড়ি ফৌজদারহাট থেকে আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের ভেতর দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছুতে পারবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার এমন বৈপ্লবিক সূচনার ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াতে সময় সাশ্রয়ের পাশাপাশি কমে আসবে দূরত্ব। বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমবে প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এটা কক্সবাজার সফর করতে ইচ্ছুক পর্যটকদের জন্য স্বস্তিকর সংবাদ। কমবে ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহণ ব্যয়ও। শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ অনেক বেড়ে যাবে। সে সুবাদে সৃষ্টি হবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মসংস্থানের। ফলে কমবে মানুষের শহরমুখি হওয়ার প্রবণতা। -পিআইডি ফিচার
মুহাম্মদ শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, ফেলো-বাংলা একাডেমি, সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া।