জীবিত আসামিকে মৃত দেখিয়ে চার্জশিট
নিজস্ব প্রতিবেদক:
মারামারির এক মামলার ‘জীবিত’ আসামিকে ‘মৃত‘ দেখিয়ে আদালতে অব্যাহতির সুপারিশ করে চার্জশিট দেয়ার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত মো. জয়নাল আবেদিনের পরিবার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন। পুলিশের দাবি, ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে আমিন জুট এলাকার খেলার মাঠে জয়নালকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে তার সহযোগী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জয়নালকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আদালত সূত্র জানায়, বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় যে জয়নাল নিহত হয়েছিলেন, তিনি সেই মামলার আসামিও নন। প্রকৃত আসামি জয়নাল এখনও জীবিত এবং আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন। অথচ মামলার আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে বলে অব্যাহতির সুপারিশ করে গত বছর ১৫ নভেম্বর আদালতে চার্জশিটও দিয়ে দেন তদন্তকর্মকর্তা বায়েজিদ বোস্তামি থানার এসআই দীপঙ্কর চন্দ্র রায়। বিষয়টি নজরে আসার পর মামলার বাদি এবং তার পক্ষের আইনজীবী ‘জীবিত’ আসামিকে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করতে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আবেদন করেছেন। আজ রোববার (১৩ সেপ্টেম্বর) ওই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে মামলার তদন্তে গাফিলতি ও অবহেলার জন্য এসআই দীপঙ্কর চন্দ্র রায়কে সাময়িক বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন সদ্যবিদায়ী নগর পুলিশ কমিশনার মাহবুবর রহমান। বিষয়টি ‘প্রফেশনালি ডিল’ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নবনিযুক্ত পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তাণভীর।
জানা গেছে, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত জয়নাল আবেদিন নগরের আমিন জুট মিল খেলার মাঠের পাশে টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট নামে সরকারি এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৮ সালে পাশ করে দশম শ্রেণিতে আর ভর্তি হয়নি। ‘বন্দুকযুদ্ধের‘ নামে ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে জয়নালের বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার নিরপরাধ ছেলেকে পুলিশ বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
সিএমপির এক কর্মকর্তার দাবি, বন্দুকযুদ্ধে নিহত জয়নালের বিরুদ্ধে বায়েজিদ বোস্তামি থানায় ৪-৫টি মারামারির মামলা ছিল। সে (জয়নাল) স্থানীয়ভাবে ‘কোপা’ জয়নাল হিসেবে পরিচিত ছিল। কিছু একটা হলেই সে মানুষকে কোপাত। এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে আহত করায় তাকে (আহত ব্যক্তি) ৫৮টি সেলাই দিতে হয়েছে। এ ঘটনায় করা মামলায় জয়নালকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। দেড়-দুইমাস পর জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার আরেক ব্যক্তিকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছিল জয়নাল আবেদীন।
নুরুল ইসলামের দবি, ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত দেড়টার দিকে আমিন জুট মিল ফুটবল মাঠ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় তার ১৭ বছর বয়সী ছেলে জয়নাল আবেদীন। সেদিন পুলিশের অস্ত্র উদ্ধার অভিযান ছিল সাজানো নাটক।’
নিহত জয়নালের খালা কুলসুম বেগমের অভিযোগ, ঘটনার তিনদিন আগে ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট বাসা (আমিন জুট মিল মূল ফটকের বিপরীতে) থেকে তার একমাত্র ভাগ্নেকে ধরে নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেছে পুলিশ। সেদিন রাতে তার বোন থানায় গেলে জয়নাল নামে কাউকে গ্রেফতার করেনি বলে জানিয়েছিল পুলিশ। পরের দিন তার বোন (জয়নালের মা) খবর নিয়ে দেখেন জয়নালকে আদালতে চালান দেয়া হয়নি। পুলিশ তাকে থানা ভবনে লুকিয়ে রাখে। ২ সেপ্টেম্বর বন্দুকযুদ্ধে জয়নাল নিহত হওয়ার খবর পান তিনি।’
পরিবারের অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে বায়েজিদ বোস্তামি থানার তৎকালীন ওসি আতাউর রহমান খোন্দকার বলেন, ‘জয়নালের বিরুদ্ধে মারামারির চারটা মামলা ছিল। সে স্থানীয় একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিত। প্রায় সময় আমিন জুট মিল ফুটবল মাঠ এলাকায় গিয়ে মারপিট করত। লোকজনকে ছুরি দিয়ে আঘাত করত।’
পুলিশের এ কর্মকর্তার দাবি, ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে গ্রেফতারের পর জয়নালকে নিয়ে আমিন জুট মিল ফুটবল মাঠ এলাকায় গেলে আগে থেকে সেখানে ওঁৎ পেতে থাকা তার সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোঁড়ে। পরে জয়নালকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। এসময় দ্রুত তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।’
এদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত মহানগর পিপি আবিদ হোসেন জানিয়েছেন মো. জয়নাল নামে আসামির জীবিত থাকা এবং মামলায় হাজিরা দেয়ার বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হয়েছে। মামলার বাদি চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া জয়নালকে অন্তর্ভুক্ত করতে আদালতে আবেদন করেছেন। আজ (১৩ অক্টোবর) মামলার শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।’ চার্জশিটে জীবিত আসামিকে পুলিশ কীভাবে মৃত দেখাল- সেটা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মন্তব্য করেন এ আইনজীবী।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে মারধরের অভিযোগ আদালতে অভিযোগ করেন নগরের রৌফাবাদ এলাকার বাসিন্দা শাহ আলম। অভিযোগ আমলে নিয়ে আদালত বায়েজিদ থানায় তা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করার আদেশ দেন। এ মামলায় নিকট আত্মীয় মো. নাসিমসহ সাতজনকে আসামি করেন তিনি। ২০১৯ সালের ১৫ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট জমা দেন এসআই দীপঙ্কর চন্দ্র রায়। মামলায় ৬ জনকে অভিযুক্ত করে দ্বিতীয় আসামি জয়নালকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করেন তিনি। ওই চার্জশিটে তিনি লেখেন- মো. জয়নাল (১৯), পিতা-আবদুল জলিল পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
পুলিশের এক কর্মকর্তার দাবি, ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর আমিন জুট মিল খোলার মাঠে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত জয়নাল আর শাহ আলমের করা মামলার আসামি জয়নাল এক ব্যক্তি নন। শাহ আলমের করা মামলার আসামি জয়নাল ২৩ দিন কারাগারে ছিলেন। বর্তমানে ওই জয়নাল জামিনে আছেন।
শাহ আলমের আইনজীবী নূরজাহান ইসলাম মুন্না গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার মক্কেলের মামলাটি ২০১৮ সালের। আর বন্দুকযুদ্ধের যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে সেটা ২০১৯ সালের মামলা।’