সনেট দেব »
জঙ্গলের নির্জন পথ ধরে হাঁটতে গেলে হঠাৎ চোখে পড়তে পারে এক অদ্ভুত সুন্দর প্রাণী। শরীরজুড়ে লালচে বাদামী রঙ, তার ওপর সাদা সাদা ফোঁটা, যেন কেউ রঙের তুলি দিয়ে যত্ন করে আঁকিবুঁকি এঁকে দিয়েছে। সে হলো চিত্রা হরিণ। অনেকেই তাকে চিতল বা চিত্রল হরিণ বলে ডাকে। ইংরেজিতে যার নাম চিতল বা চিটাল। নামটির উৎস এসেছে আমাদের বাংলার “চিত্রা” শব্দ থেকে, যার অর্থ হলো ছোপযুক্ত বা ফোঁটাওয়ালা। সত্যিই এরা যেন বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা জীবন্ত এক চিত্রকর্ম।
চিত্রা হরিণ শুধু আমাদের বাংলাদেশেই নয়, ভারত, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার বনে বনে ঘুরে বেড়ায়। সুন্দরবনের ভেতর এদের দেখা মেলে দল বেঁধে। কখনো আবার একসাথে শ’খানেক হরিণও দেখা যায়। নিঝুম দ্বীপেও এদের সংখ্যা বেশ ভালো। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, মানুষ এই হরিণকে এতই পছন্দ করেছে যে পৃথিবীর অনেক দেশে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন আমেরিকার টেক্সাস বা হাওয়াই দ্বীপেও এরা থাকে, আবার অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলেও মানুষ ইচ্ছা করে তাদের ছেড়ে দিয়েছে, যেন সেখানকার প্রকৃতি আরও সুন্দর হয়।
চিত্রা হরিণের গড়নও চমৎকার। এদের গায়ে সাদা ফোঁটার সারি এমনভাবে সাজানো যে মনে হয় লাল মখমলের ওপর মুক্তোর মালা জড়িয়ে আছে। পেট, গলা আর পায়ের ভেতরটা ঝকঝকে সাদা, আর পুরুষ হরিণের মাথায় থাকে রাজমুকুটের মতো লম্বা শিং। এ শিং বেশ ভারী আর শক্তিশালী। চমৎকার ব্যাপার হলো, এ শিং মাঝে মাঝে নিজে থেকেই পড়ে যায় এবং আবার নতুন করে গজিয়ে ওঠে। ঠিক যেন কোনো জাদু! এই শিং-এর কারণে পুরুষ হরিণ দেখতে অনেক বেশি রাজকীয় লাগে। কখনো কখনো শিং ভেঙেও যায়, কিন্তু হরিণ তাতে দমে না—আবার নতুন শিং গজায়।
তাদের দৈনন্দিন জীবনে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো খাওয়া। সবুজ ঘাস, গাছের কচি পাতা, ডালপালা—এসবই এদের প্রধান খাবার। সুন্দরবনের কেওড়া, গেওয়া, গরান কিংবা কাঁকড়ার মতো গাছের কচি পাতা এরা খুব মজা করে খায়। মজার বিষয় হলো, অনেক সময় বানররা গাছ থেকে ফল বা ডালপালা ছিঁড়ে ফেলে দিলে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা চিত্রা হরিণ সেগুলো চট করে খেয়ে ফেলে। যেন বানর আর হরিণের মধ্যে একধরনের বন্ধুত্ব আছে। আবার কখনো এরা দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ওপরের ডাল থেকে কচি পাতা ছিঁড়ে খায়, একেবারে ব্যালেরিনার মতো ভঙ্গিতে। পোষ মানা হরিণ আবার আমাদের খাওয়া সবজি, যেমন বাঁধাকপি, বরবটি বা শিমও খেতে পছন্দ করে।
চিত্রা হরিণ দল বেঁধে থাকতে ভালোবাসে। এদের দলে কখনো কেবল কয়েকটা নয়, বরং ডজনের পর ডজন হরিণও থাকতে পারে। দলে সাধারণত একটি প্রভাবশালী পুরুষ থাকে, যে অন্যদের রক্ষা করে। শিকারিরা কাছে এলেই এরা সতর্ক সংকেত দেয় আর দৌড়ে পালিয়ে যায়। চিত্রা হরিণ দৌড়ে চলে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যে—তাদের দৌড় যেন বাতাসের মতো হালকা।
চিত্রা হরিণের সংসারও বেশ মজার। স্ত্রী হরিণ বছরে একবার একটি করে বাচ্চা দেয়। ছোট্ট বাচ্চাগুলোর গায়ে জন্মের পরই থাকে সাদা সাদা ফোঁটা, ঠিক মায়ের মতো। এরা প্রথম ছ’মাস মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়, তারপর ধীরে ধীরে ঘাস আর পাতা খেতে শেখে। চিত্রা হরিণ দলে বাচ্চাদেরও খুব যত্নে রাখে, যেন সব বড়রা মিলে তাদের পাহারা দেয়।
চিত্রা হরিণ শুধু সুন্দর বলেই নয়, প্রকৃতির জন্যও খুব জরুরি। তারা বনকে পরিষ্কার রাখে, অতিরিক্ত গাছের চারা আর ঘাস খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। আবার অনেক প্রাণী, যেমন বাঘ বা কুমির, এদের খেয়ে বেঁচে থাকে। তাই এক অর্থে চিত্রা হরিণ বনের জীবনচক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আজ পৃথিবীর অনেক জায়গায় বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে, শিকারিরা হরিণ ধরে নিচ্ছে, তাই এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার চিত্রা হরিণকে সংরক্ষিত প্রাণী ঘোষণা করেছে। আমরা যদি বনকে রক্ষা করি, শিকার বন্ধ করি, তাহলে এই দাগওয়ালা রাজকুমাররা আমাদের বনে-বনে অনেকদিন ধরে নাচতে-দৌড়াতে থাকবে।
আমাদের মনে রাখা উচিত, বনের প্রাণীরা আমাদের বন্ধু। আমরা যেমন নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য গাছ চাই, তেমনি বনের সৌন্দর্য আর ভারসাম্য রক্ষার জন্য চিত্রা হরিণ চাই। তোমরা যদি আজ থেকেই প্রতিজ্ঞা করো গাছ কেটে ফেলবে না, প্রাণীদের কষ্ট দেবে না, তাহলে হয়তো একদিন সত্যিই তুমি সুন্দরবনে গিয়ে দেখবে—দল বেঁধে ছুটে চলেছে চিত্রা হরিণ, যেন প্রকৃতির আঁকা এক জীবন্ত রূপকথা।