সুভাষ দে »
জাতিসংঘ ফিলিস্তিন জনগণের স্বাধীনতা ও ন্যায্য, মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানাতে ২৯ নভেম্বরকে ‘ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি’ দিবস পালনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। সত্তর ও আশি ও নব্বই এর দশকে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব ভূমিতে স্বাধীনভাবে বাঁচার দাবির প্রতি বিশ্বের অনেক দেশ এবং লেখক, বুদ্ধিজীবী ও শান্তিকামী জনগণ ব্যাপক সমর্থন জানিয়েছে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন পিএলও’র (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) এর প্রতি। জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূÑখ-ে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে । কিন্তু সে প্রস্তাব বাস্তবায়নে জাতিসংঘের যে দৃঢ় সক্রিয় ভূমিকা থাকা প্রয়োজন তা লক্ষ্য করা যায়নি প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের চাপের কারণে। জাতিসংঘ গাজা ও পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে স্বীকৃতি দিলেও ইসরায়েল ফিলিস্তিনের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব ত্যাগ করেনি বরং প্রতিনিয়তই ইসরায়েল ফিলিস্তিন ভূ-খ-ে অবৈধ বসতি গড়ে তুলেছে বছরের পর বছর। তারা ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন, ধ্বংসলীলা অব্যাহত রেখেছে। তাদের ভূ-খ- ত্যাগে বাধ্য করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে ফিলিস্তিন পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ইসরায়েলের চ-নীতি আরো ব্যাপক হয়েছে এবং তাদের সহিংসতা, ফিলিস্তিনি ভূÑখ-ের জবরদখল বেড়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমন সা¤্রাজ্যের পতনের পর ব্রিটিশ ও ফরাসীরা মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। ফিলিস্তিনের অধিকার পায় ব্রিটিশরা, যুদ্ধশেষে তারা ‘বেলফুর’ ঘোষণার মাধ্যমে ইহুদিদের ফিলিস্তিন ভূখ-ে বসতির সুযোগ করে দেয়। কালক্রমে বিশ্বের নানা দেশ থেকে ইহুদিরা এসে ফিলিস্তিনে আবাস গড়ে তোলে। ১৯৪৮ সালে তারা ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করে। সেই থেকেই তারা একের পর এক ফিলিস্তিনি ভূ-খ- দখল করে মূল অধিবাসী ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করে। আজ ফিলিস্তিনিরা নিজভূমে পরবাসী।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিন ভূ-খ-ে ২টি স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপনের প্রস্তাব নেয় কিন্তু ইসরায়েল তাতে কর্ণপাত না করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তার দখলদারিত্ব কায়েম করে। লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। বিগত শতকের ষাটের দশক থেকেই ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধ সংগ্রামে ফিলিস্তিনের মুসলিম, খ্রিস্টান এবং নানা গোত্রের মানুষ অংশ নেয়।
এটি বিশ্বের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে এক অবিস্মরণীয় মুক্তির সংগ্রাম। ইয়াসির আরাফাত জাতিসংঘে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমার ফিলিস্তিন হবে সেক্যুলার রাষ্ট্র, এখানে মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি সকলেই সমান অধিকার নিয়ে বাস করবে’। ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় বৃহত্তম গেরিলা সংগঠন ছিল ড. জর্জ হাবাশ পরিচালিত চঋখচ (চড়ঢ়ঁষধৎ ঋৎড়হঃ ভড়ৎ খরনবৎধঃরড়হ ড়ভ চধষবংঃরহব) । এই দলের গেরিলা যোদ্ধা লায়লা খালেদ এক বিমান ছিনতাই করে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।
ফিলিস্তিনের জাতীয়তাবাদী, বামপন্থি, গণতান্ত্রিক ছোটবড় রাজনৈতিক দল এবং ফিলিস্তিন ভূ-খ-ে বসবাসরত মুসলিম, খ্রিস্টান ও শান্তিকামী ইহুদি জনগোষ্ঠীর লোকজন যোগ দেয় এই জাতীয় সংগ্রামে। ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের মহান নেতা ইয়াসির আরাফাত গঠন করেন পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থা)। ইয়াসির আরাফাতের প্রজ্ঞা, সফল কূটনীতি আর স্বাধীনতার জন্য গেরিলা যুদ্ধ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবির, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, বিশ্ব শান্তি পরিষদ, ইউরোপ-আমেরিকার শান্তি ও গণতন্ত্রকামী সংস্থা, বিশ্বের লেখক বুদ্ধিজীবী ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনরত দেশগুলির বিপুল সমর্থন লাভ করে। ইয়াসির আরাফাত জাতিসংঘে একবার বলেছিলেন ‘ও পধসব নবধৎরহম ধহ ড়ষরাব নৎধহপয রহ ড়হব যধহফ ধহফ ঃযব ভৎববফড়স ভরমযঃবৎ মঁহ রহ ঃযব ড়ঃযবৎ. উড় হড়ঃ ষবঃ ঃযব ড়ষরাব নৎধহপয ভধষষ ভৎড়স ধহু যধহফ’. ‘আমি আমার এক হাতে জলপাই গুচ্ছ এবং আর এক হাতে মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র নিয়ে এসেছি। দয়া করে আমার হাত থেকে জলপাই গুচ্ছ পড়ে যেতে দেবেন না’। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য বিজয় এবং একই সাথে শান্তির জন্য প্রবল তৃষ্ণা-এই দুটি একই সাথে অর্জনের জন্য দশকের পর দশক লড়েছেন ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ও যোদ্ধা ইয়াসির আরাফাত এবং পিএলও।
১৯৯৩ সালে অসলোতে ১ম দফা এবং ওয়াশিংটনে দ্বিতীয়বার ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এতে ফিলিস্তিনের স্ব-শাসন এবং পর্যায়ক্রমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। ফিলিস্তিন ইসরায়েলের রাষ্ট্রসত্তা স্বীকার করে নেয়। বিগত ৬ দশক ধরে ফিলিস্তিনিরা তাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। অসলো শান্তি চুক্তির পর ফিলিস্তিনে স্ব-শাসন প্রতিষ্ঠায় ইয়াসির আরাফাত সীমিত পরিসরে হলেও সফল হয়েছিলেন কিন্তু আরাফাতের মৃত্যুর পর ইসরায়েলের দখলদারিত্ব, ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন বৃদ্ধি পায়।
শান্তি চুক্তির ২৭ বছর পরও শান্তি অধরা। বরং ইসরায়েল ও তার আন্তর্জাতিক দোসররা নতুন নতুন চক্রান্ত শুরু করে। বিশেষ করে ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল চরম আগ্রাসী মনোভাব নেয়। আমেরিকা জেরুজালেমে দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার কথা বলে, এতে ‘জেরুজালেম’ নগরীর বিশেষ মর্যাদা ক্ষুণœ হবে। এই নগরটিকে জাতিসংঘ বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। এই নগরটি ৩ ধর্মের মানুষের কাছে পবিত্র নগরী। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকায় ফিলিস্তিন দূতাবাস বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারা জাতিসংঘের ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসন সহায়তা তহবিলে চাঁদা না দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আমেরিকার নির্বাচনের কিছুদিন আগে ট্রাম্পের ইন্ধনে মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সৌদি আরবও ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে নমনীয় হয়েছে। এর আগে ১৯৭৯ সালে মিশর এবং ১৯৯৪ সালে জর্ডানের সাথে ইসরায়েলের চুক্তি হয়।
এ ধরণের প্রচেষ্টা ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান নয়। বরং তা আরো জটিল করে তুলবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের স্বার্থ নিরাপদ করতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে জাতিগত, গোত্রগত ও ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধÑসংঘর্ষ জিইয়ে রেখেছে। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে ৩ বার ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ করে আরব রাষ্ট্রগুলি পরাজিত হয়। অসলো শান্তি চুক্তিতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার স্বীকৃত হলেও ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ওপর দমন নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির পরিবর্তন না হলে, সেখানে বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে যুদ্ধ ও সংঘাতের অবসান না হলে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
হোয়াইট হাউসে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। ডেমোক্র্যাট পার্টির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইহুদি লবি এবং অস্ত্র ব্যবসায়ীদৈর চাপ কতটুকু নিতে পারবেন তা-ই বিবেচ্য। গৃহযুদ্ধ, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ, আঞ্চলিক যুদ্ধ আর উত্তেজনা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে রাখছে যে পরাশক্তিটি, সে দেশটি সমানে অস্ত্র বিক্রি করছে সকল পক্ষের কাছে। গত কয়েক বছর ট্রাম্প পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা বিশ্বের ভারসাম্যকর পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিকে খ- খ- করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ইসরায়েল নিরাপদ থেকেছে। তার শক্তি বেড়েছে আর ফিলিস্তিনিদের ওপর দমননীতি অব্যাহত থেকেছে। বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি কতটুকু সামলাতে পারবেন, যুদ্ধ-সংঘাত পরিহার করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে তিনি কতটুকু সফল হবেন, ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ এবং বহুজাতিক শান্তি প্রস্তাব (অসলো, ১৯৯৩) অনুসারে অগ্রসর হবেন কিনা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।
এটি দুঃখজনক যে, ফিলিস্তিনিদের স্ব-শাসন প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ওআরব রাষ্ট্রগুলির ভূমিকা দুঃখজনক। ইসরায়েলের নয়া ঔপনিবেশিক ও ফ্যাসিবাদি তা-ব রুখতে ফিলিস্তিনবাসীকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ সংগ্রাম ও কূটনৈতিক প্রয়াস চালাতে হবে।
দুর্ভাগ্যজনক যে, ফিলিস্তিনিরা নানামত ও পথে বিভক্ত; তাদের অনৈক্য আর ভ্রান্তির সুযোগ নিচ্ছে ইসরায়েল আর এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে ফিলিস্তিনবাসীকে। বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইসরায়েলের চুক্তির পর ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক দল ফাত্তাহ, হামাস ও ইসলামিক জেহাদের নেতারা বৈঠকে মিলিত হয়েছেন।
আমরা চাই জাতিসংঘ এবং অসলো শান্তি চুক্তির সাথে যুক্ত দেশগুলি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে আলাপ-আলোচনা শুরু করবে। একটি সুপ্রাচীন সভ্যতার জনপদে রক্তক্ষরণ নিয়মিত ঘটে চলেছে। এই অবস্থা বিশ্বশান্তির জন্য অনুকূল নয়। ফিলিস্তিনিদের ন্যায়সংগত ও মানবিক সংগ্রামে বিশ্বের শান্তিকামী ও বিবেকবান মানুষ, লেখক-বুদ্ধিজীবীগণ সোচ্চার হবেন তবেই ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি যথার্থ হবে।
লেখক : সাংবাদিক