প্রায় শত কোটি টাকার সম্পত্তি : সরকারি সম্পত্তি বেহাতের চেষ্টা

শুভ্রজিৎ বড়ুয়া
ইহুদির পরিচয় খ্রিস্টান দেখিয়ে মৃত্যু, কবর ও ওয়ারিশ সনদ জালিয়াতি করে প্রায় শত কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টা করছেন আলবার্ট সরকার। এ জালিয়াতিতে সরকারের কাছ থেকে আদালতের মাধ্যমে প্রায় কয়েক শত কোটি টাকার সম্পত্তি হাতছাড়া হতে চলেছে। এসব জায়গায় ৮০ বছরের বেশি সময় ধরে যারা ভাড়া থাকছেন, তাদেরও দেওয়া হচ্ছে জায়গা কেনার প্রস্তাব না হলে উচ্ছেদের হুমকি। সরকার পক্ষের আইনজীবী এ জাল-জালিয়াতির বিষয়ে স্পষ্টভাবে জানলেও তথ্য প্রমাণের জটিলতায় আদালতে হেরে যাওয়ার কথা জানান।
জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে এ উপমহাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী ডেভিড ইজিক্যাল নামে এক ইহুদি ব্যবসায়ী দেশের অন্য জায়গাসহ চট্টগ্রামে ১৮৮১ সালে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একই সময়ে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানা এলাকায় ৬৯ দশমিক ৭ শতক ভূমিতে কয়েকটি ভবন নির্মাণ করেন। যা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেন তার স্ত্রী রিমা ইজিক্যালকে। তাদের দাম্পত্যজীবনে রমা ইজিক্যাল, রাচেল ইজিক্যাল ও ন্যান্সি ইজিক্যাল নামে তিন কন্যা ও হারভার্ট হাফ ইলিস ইজিক্যাল নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। রিমা ইজিক্যালের পর চট্টগ্রামের সম্পত্তিগুলো দায়িত্ব পালন করেন তাদের বড় মেয়ে রমা ইজিক্যাল। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আনুমানিক ১৯৬৫ সালে পুরো পরিবার লন্ডনে চলে যান। যা ডেভিড ইজিক্যালের ছোট মেয়ে ন্যান্সির বায়োগ্রাফিতে স্পষ্ট হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ন্যান্সি লন্ডনের রয়েল একাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টের (রাডা) একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী ছিলেন। ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে তার জন্ম এবং তিনি ২০১২ সালে ৯৪ বছর বয়সে মারা যান। তবে এলভার্ট সরকার নামে এক ব্যক্তি থাকেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, যিনি নিজেকে দেখিয়েছেন ডেভিড ইজিক্যালের একমাত্র নাতি। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন- তার মায়ের নাম দেওয়া হয়েছে কনক সরকার ও বাবার নাম গোপাল সরকার। তিনি আদালতকে জাল সনদ দিয়ে বুঝিয়েছেন ডেভিড ইজিক্যালের একমাত্র মেয়ে কনক ইজিক্যাল। যার মৃত্যু হয় ২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বর। তবে আদালতে দাখিল করা মৃত্যুর সনদে তারিখ উল্লেখ করা হয় মৃত্যুর ছয় দিন আগে। ডেভিড ইজিক্যালের মৃত্যুর পর তার দাফন পাথরঘাটাস্থ গির্জার কবরস্থানে বলে উল্লেখ করে জাল কাগজপত্র তৈরি করে তা আদালতে দাখিল করে এলভার্ট। তার দাখিল করা মৃত্যুর সনদ ও ওয়ারিশ সনদ জাল বলে বিবৃতি দেন ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী এবং ৩৩, ৩৪ ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত কাউন্সিলর লুৎফুন্নেছা দোভাষ। এছাড়াও ডেভিড ইজিক্যাল নামে কারো দাফনও পাথরঘাটাস্থ হলি রোসারি ক্যাথেড্রাল কবরে হয়নি বলে লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন দায়িত্বরত ফাদার রিগান ক্ল্যামেন্ট ডি’কস্তা। এ তথ্যসংক্রান্ত কাগজপত্র সুপ্রভাতের কাছে সংরক্ষিত আছে।
এস. ইজিক্যাল এন্ড কোং-এর রেখে যাওয়া সম্পদগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, চট্টগ্রামের জেনারেল পোস্ট অফিসের (জিপিও) মুখোমুখি সদরঘাট রোডের উত্তর পাশে সিমেন্টে ইংরেজি অক্ষরে খোদাই রয়েছে- ইজিক্যাল এন্ড কোং, প্রতিষ্ঠিত-১৮৮১। খবর নিয়ে জানা যায়, ভবনটির মুখোমুখি রাস্তার দক্ষিণ পাশে ও পূর্ব-দক্ষিণে বেশ কয়েকটি ভবন রয়েছে। ভবনগুলোতে দোকান ও আবাসিক স্থাপনা ব্যবস্থা রয়েছে। ভবনে ভাড়া নিয়ে থাকা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, দোকান ও বাসাগুলো তারা ১৯৪২ সাল থেকে রশিদ নিয়ে ভাড়া দিয়ে আসছিলেন। কেউ দাদা আর কেউ বাবার সময় থেকে এ অবস্থান ধরে রেখেছেন। তারা ক্রমানুসারে রিমা ইজিক্যাল, তার মেয়ে রমা ইজিক্যাল, পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ও বাংলাদেশ সরকার থেকে ভাড়া নিয়ে সেখানে আছেন।
এ বিষয়ে ওখানকার ভাড়াটিয়া টিপু সুলতান বলেন, ‘এখানে ব্যবসা পরিচালনার জন্য দোকান ভাড়া নিয়েছিলেন আমার আব্বা হামিদ বক্স। তখন মাসিক ভাড়া ছিলো ৫ টাকা, যা ১৯৪২ সালের ভাড়ার রশিদে আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমরা ডিসি অফিসে বছরে একবার ভাড়া দিয়ে আসি। স্বাধীনতার পর বাৎসরিক ভাড়া ছিলো ১৫০ টাকা। আর বর্তমান আমরা বাৎসরিক দেড় লাখ টাকা ভাড়া দিচ্ছি। এরকম এখানে অনেকে আছেন। তারা অন্য কোথাও যে পারবে না, এমনটা নয়। কিন্তু আমরা পূর্বপুরুষের চিহ্ন ধরে রাখতে চাই। আমরা এ জায়গা নিয়ে কী মামলা-মোকদ্দমা চলছে তা জানি না। আমরা সরকারকে নিয়মিত ভাড়া নিয়ে অবস্থান ধরে রেখেছি। তবে ইদানিং একটি পক্ষ আমাদের প্রস্তাব পাঠিয়েছে, তার কাছ থেকে জায়গাগুলো কিনে নিতে। নতুবা আমাদের এখান থেকে উচ্ছেদ করা হবে। এ বিষয়টি আমরা বুঝতে পারছি না।’
এ বিষয়ে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন ট্রাইবুনালের সরকার পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট অনুপ কুমার চৌধুরী বলেন, ‘এলভার্ট সরকার ডেভিড ইজিক্যালের ওয়ারিশ নয়। তিনি ইজিক্যাল পরিবারের সাথেও কোনোভাবে সম্পর্কিত নয়। তাই আমি এই মামলায় আদালতকে বিষয়টি জানিয়েছি। তার সনদগুলো হাজারিগলি থেকে জাল করার বিষয়ও আমি আদালতকে বলেছি। কিন্তু আদালতকে পর্যাপ্ত প্রমাণাদি দিতে না পারায় রায় তাদের পক্ষে চলে যায়। আর অর্পিত সম্পত্তি বিষয়ে আইন আছে যে কেউ যদি ফেলে যাওয়া সম্পত্তির ওয়ারিশ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে তাদের সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে।’
এ নিয়ে কথা হলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘জায়গাটি সম্পর্কে আমার স্পষ্ট জানা না থাকায় কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এখানে যদি কেউ জাল-জালিয়াতি করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জালিয়াতি করে পার পাওয়ার সুযোগ কারোরই নেই।’