বিশেষ প্রতিবেদন »
আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের চীন সফরে যাচ্ছেন। রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সফরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। অপরদিকে বেইজিং চায়—তাদের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উদ্যোগে ঢাকার আরও বেশি সম্পৃক্ততা।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গত ১০ বছরে চারবার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। ২০১৪ সালে বেইজিংয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফর, ২০১৬ সালে শি জিন পিংয়ের ঢাকা সফর, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আবার বেইজিং সফর এবং ২০২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে তাদের মধ্যে বৈঠক হয়। আর এবার চার দিনের দ্বিপক্ষীয় সফরে বেইজিং যাচ্ছেন শেখ হাসিনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় পুরোটাই চীনের পক্ষে। গত বছর চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে প্রায় ২১০০ কোটি ডলারের পণ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশ রফতানি করেছে প্রায় ৭০ কোটি ডলারের সামগ্রী। বাংলাদেশকে ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় চীন এবং বাংলাদেশ যা রফতানি করে সেটির ৭০ শতাংশ ওই সুবিধার মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশ চায় রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং ওইসব খাতে চীনা বিনিয়োগ, যা আবার চীনে রফতানি করা সম্ভব। বর্তমানে ছয় শতাধিক চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করে এবং এর মধ্যে প্রায় ২৫টির আঞ্চলিক প্রধান দফতর বাংলাদেশে।
২০১৬ সালে যে ২৭টি প্রকল্পের বিষয়ে দুইপক্ষ সম্মত হয়েছিল, তারমধ্যে ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, ছয়টির কাজ চলছে এবং ছয়টির বদলে অন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। এর মধ্যে আটটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, যেমন- পদ্মা রেল লিংক, ইনফো সরকার, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংসহ টেলিকম ও বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প রয়েছে। ওই প্রকল্পগুলোতে মোট চীনা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৭৮০ কোটি ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হিসাবে, গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চীন থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে ৫৬০ কোটি ডলার। চীন অত্যন্ত দ্রুত বাংলাদেশে তাদের ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। এসব প্রকল্পের ঋণের হার দুই থেকে তিন শতাংশ এবং পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে পরিশোধযোগ্য, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বোঝা। বাংলাদেশ চায় ঋণের হার কমাতে এবং পরিশোধযোগ্য সময় বাড়াতে।
বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে মানুষে মানুষে যোগাযোগ আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় বেশি। একদিকে অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এখন চীনে পড়তে যাচ্ছে। অন্যদিকে চীনের সংস্কৃতি বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কসফুসিয়াস সেন্টার স্থাপন বা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি করাসহ একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে বেইজিং। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, মিডিয়ার সদস্যসহ বিভিন্ন ব্যক্তিদের সফরে আমন্ত্রণ জানিয়ে নতুন ও উন্নত চীনকে দেখানো হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর এই সফরটি চারি দিনের বলা হলেও মূল সফরটি হচ্ছে দুই দিনের। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের কথা রয়েছে। তবে সফরের মূল কর্মসূচি ৯ ও ১০ জুলাই সীমিত থাকবে।
৯ জুলাই দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে। ১০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এ সফরের সময় চীনের পার্লামেন্ট ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস অব চায়নার প্রেসিডেন্ট ঝাও লেজির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে।
জাপানের সহায়তায় মাতারবাড়ী-মহেশখালী ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (মিডি) বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। এর আওতায় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র (হাব) করে বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চলের উন্নতির পরিকল্পনা করা হয়েছে।
পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে (সাউদার্ন ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ বা সিডি) চীনের সহায়তা চায় বাংলাদেশ। মিডির মূল অংশীদার যেমন জাপান তেমনি সিডির মূল অংশীদার হোক চীন, এটাই চায় বাংলাদেশ।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় মেট্রোরেলের ছয়টি লাইন নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হয়েছে। গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রোরেল লাইন-২–এর ঋণ এখনো নিশ্চিত হয়নি। এ প্রকল্পের জন্য চীনা ঋণ পেতে আগ্রহী সড়ক মন্ত্রণালয়।
পাশাপাশি ঋণ ও বাজেট সাপোর্ট নিয়ে আলোচনা চলছে। আশা করা হচ্ছে, বেশ কিছু প্রকল্পের বিষয়ে আসন্ন সফরে ঐক্যমত্যে পৌঁছাবে দুই দেশ।
সড়ক ও রেল যোগাযোগ খাতের নয়টি প্রকল্পে চীনা ঋণের বিষয়ে আগ্রহী বাংলাদেশ। তালিকায় রেলের প্রকল্প রয়েছে ছয়টি। ফরিদপুরের ভাঙা থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর এবং কুয়াকাটা পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণে অগ্রাধিকার রয়েছে সরকারের।
এর বাইরে ঢাকায় গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পথে মেট্রোরেলের একটি লাইন নির্মাণ, পিরোজপুরের কচা নদীর ওপর নতুন একটি সেতু নির্মাণ এবং মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর সেতুর মেরামত প্রকল্প রয়েছে।
প্রায় এক দশক পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে বাংলাদেশের জন্য চীনের ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৪০ কোটি ইউয়ানের বেশি ঋণ দেওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে পররাষ্ট্র ও ইআরডি সূত্রে জানা গেছে।
দ্বিপক্ষীয় এ সফরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কমপক্ষে ১০টি চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে।