প্রদীপের নির্দেশে লিয়াকতের গুলিতে খুন হন সিনহা

আদালতে সিনহার বোন শারমিন

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বহুল আলোচিত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।
গতকাল সোমবার থেকে ২৫ আগস্ট বুধবার পর্যন্ত টানা তিনদিন এই সাক্ষ্যগ্রহণ চলবে। এ সময় মামলার ১ থেকে ১৫ নম্বর সাক্ষীরা তাদের সাক্ষ্য দেবেন। মামলার বাদি ও প্রথম সাক্ষী নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসকে দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম।
তিনি বলেন, এই মামলায় মোট সাক্ষী ৮৩ জন। আদালতে হাজির থাকতে ১৫ জন সাক্ষীকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণের সময় মামলার ১৫ জন আসামিকেও আদালতে হাজির করা হবে।
ফরিদুল আলম বলেন, গত ২৬ জুলাই থেকে পরবর্তী তিনদিন সাক্ষ্য গ্রহণের সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু করোনা সংক্রমণ রোধে কঠোর বিধিনিষেধ চলায় তা সম্ভব হয়নি।
টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে সিনহা মো. রাশেদ খান খুন হন বলে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন মামলার বাদি শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস।
মামলার বাদি ও নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস সাংবাদিকদের জানান, ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে বিস্তারিত বিবরণ জেনে ২০২০ সালের ৫ আগস্ট আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের প্রথমদিনে আমি মূলত জবানবন্দি দিয়েছি। আমাকে বিভিন্ন আসামিদের আইনজীবীরা আমাকে জেরা করেছে। আমি তার জবাব দিয়েছি। এটি পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ওসি প্রদীপ লিয়াকতসহ সকল আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।’
মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত বলেন, মামলার বাদি মেজর সিনহার বড়বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস ১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। অন্য আসামিদের আইনজীবীরা তাদের জেরা শেষ করেছে। তবে ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতের জেরা হবে মঙ্গলবার।’
আদালত সূত্রে জানা যায়, সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়েছে। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদি হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়।
হত্যাকাণ্ডের পাঁচদিনের মাথায় ২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদি হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
আদালত থেকে র‌্যাব-১৫ কে মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয়। প্রথমে ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন, র‌্যাব -১৫এর সহকারী পুলিশ সুপার জামিল আহমদ। পরে তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তিত হয়ে র‌্যাবের সহকারী পরিচালক ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম তদন্তের দায়িত্বভার পান।
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র‌্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম।
আসামিদের মধ্যে রয়েছেন পুলিশের ৯ সদস্য। তারা হলেন- বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, কনস্টেল রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া ও কনস্টেবল সাগর দেব নাথ।
আলোচিত এই মামলায় বর্তমানে কারাগারে থাকা ১৫ আসামি হলেন বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাগর দেব, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
গেল ২৭ জুন (রোববার) ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০২/২০১/১০৯/ ১১৪/১২০-খ/ ৩৪ ধারায় সকল আসামির উপস্থিতিতে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালত মামলার অভিযোগ গঠন করেন। এছাড়া, ছয় আসামির পক্ষে আদালতে জামিন চাওয়া হলে আদালত তা নামঞ্জুর করেন। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম মামলাটির চার্জ গঠনের শুনানি করেন।
চার্জ গঠন করে ২৬ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ৩ দিন মামলাটির চার্জশিটভুক্ত প্রথম ১০ জন সাক্ষীর সক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম না চলায় নির্ধারিত ধার্য দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়নি বলে জানান মামলাটির রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী পিপি ফরিদুল আলম।
মামলার বাদিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ৩ দিনে ১৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হলে মামলার মোট ৮৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করতে সর্বোচ্চ ৬ মাস সময় লাগতে পারে।
এদিকে মামলার ১৫ জন আসামির মধ্যে ১২ জন নিজের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। ফলে এই মামলার রায় দ্রুত শেষ করা সম্ভব।
এদিকে, সিনহা হত্যা মামলাটি বেআইনি ও অবৈধ দাবি করে ৪ অক্টোবর মামলার প্রধান আসামি লিয়াকতের আইনজীবী মাসুদ সালাহ উদ্দিন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু ওই মামলার বিশেষ কোনো অগ্রগতি এখনও পর্যন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।