রিনিক মুন »
রোদটা আজ কেমন যেন নরম। জানালার পাশে বসে তুষ্টি খাতায় কিছু লিখছিল। খাতার পাতায় ঝরে পড়া সূর্যালোকটা যেন শব্দের সঙ্গে মিশে ছোট ছোট আলো ছড়াচ্ছে।
তবু তার মনটা ভারী। গণিত পরীক্ষায় আবারও শূন্যের কাছাকাছি নম্বর পেয়েছে সে। সহপাঠীরা হাসছে, আর শিক্ষকরা বলছেন-তুষ্টি, তুমি কবে একটু মন দেবে পড়াশোনায়?
তুষ্টি চুপ করে থাকে। সে জানে না, কেন তার মাথার ভেতর অক্ষরগুলো আর সংখ্যাগুলো যেন ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরে বেড়ায়, একটার সঙ্গে আরেকটা মেলাতে গেলেই হারিয়ে যায় অর্থ।
বাড়িতেও কেউ বোঝে না তাকে। বাবা প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে বলেন-
তুমি কি কিছুই বোঝো না? অন্যদের মতো হতে পারো না?
তখন তুষ্টির মনে হয়, সে যেন অন্ধকার ঘরে আটকে আছে-যেখানে জানালাও নেই, বাতাসও নেই।
একদিন বিকেলে ক্লাসে এলেন নতুন এক শিক্ষক-সৌরূপ স্যার। বয়স তেমন বেশি নয়, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, মুখে নরম হাসি। প্রথম দিনেই তিনি বোর্ডে বড় করে লিখলেন-
“শেখা মানে শুধু মুখস্থ নয়, দেখা-বোঝা-মনে রাখা।”
তুষ্টি তখনও জানত না, এই মানুষটিই একদিন তার জীবনের দিকটাই বদলে দেবেন।
পরের দিন স্যার ক্লাসে ঢুকে বললেন-আজ আমরা শুধু গল্প করব।
ছাত্র-ছাত্রীরা সব অবাক।
স্যার বললেন—তোমরা জানো, একসময় আমিও একদম তোমাদের মতোই ছিলাম-পড়াশোনায় মন বসত না। কিন্তু একদিন বুঝলাম, অঙ্কও একটা গল্প। সংখ্যার ভেতরেও আছে ছন্দ, যুক্তি আর আলো।
তুষ্টি চুপচাপ শুনছিল। তার ভেতর কোথাও যেন এক ফোঁটা আলো জ্বলে উঠছিল।
ক্লাস শেষে স্যার তাকে ডেকে বললেন,
তুষ্টি, তুমি একটু থেকে যাও তো।
তুষ্টি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।
স্যার মৃদু হেসে বললেন,
তোমার চোখে আমি একরাশ প্রশ্ন দেখি। জানো, প্রতিটা প্রশ্নই একেকটা জানালা। দরকার শুধু সাহসগুলো খুলে দেওয়ার। সেদিন স্যার বোর্ডে একটা বৃত্ত আঁকলেন। বললেন-এটা তোমার ভয়। এর বাইরেই তোমার আলো।
তারপর হাতে চক তুলে দিলেন তুষ্টির দিকে।-তুমি পারবে এটা ভাঙতে।
তুষ্টি একটু ইতস্তত করল, তারপর হাতে থাকা চক দিয়ে বৃত্তের বাইরে একটা রেখা টেনে দিল।
স্যার হাসলেন দেখলে, -আলোটা ঠিক এখানেই!
এরপর থেকে প্রতিদিন স্কুল শেষে তুষ্টি একটু থেকে যেত।
সৌরূপ স্যার তাকে শেখাতেন সংখ্যার জাদু, সমীকরণের সহজ পথ, অঙ্কের গল্প।
কখনো বলতেন-তুষ্টি, তুমি যদি নিজেকে বিশ্বাস করো, তাহলে পৃথিবীর কোনো অঙ্কই অসম্ভব থাকবে না।
ধীরে ধীরে তুষ্টি বদলে গেল। যে সংখ্যা একসময় তার কাছে ভয়ানক ছিল, সেগুলোই এখন হয়ে উঠল বন্ধুর মতো।
তার খাতায় ভরতে লাগল সুন্দর হাতের লেখা, সোজা দাগ, আর প্রতিটি অঙ্কের ভেতর আত্মবিশ্বাস।
একদিন স্কুলে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী।
তুষ্টি তাকিয়ে দেখল মঞ্চে নাম ঘোষণা হচ্ছে-
গণিতে শ্রেষ্ঠ ছাত্রী :- তুষ্টি রানী।
সবার চোখ তার দিকে।
সে এগিয়ে গেল, পুরস্কার নিল সৌরূপ স্যারের হাত থেকে।
স্যারের চোখে তখন গর্বের উজ্জ্বলতা-আর তুষ্টির চোখে জলে ভাসা হাসি।
পুরস্কার নিতে গিয়ে তুষ্টি শুধু ফিসফিস করে বলল-
স্যার, আমি পারতাম না যদি আপনি আলো না দেখাতেন।
সৌরূপ স্যার মাথায় হাত রেখে বললেন-আমি শুধু জানালা খুলে দিয়েছি, আলোটা সবসময় তোমার ভেতরেই ছিল।
বছর কেটে যায়।
তুষ্টি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
ছোট ছোট শিশুদের পড়ায় সে-যারা এখনও অন্ধকারে ঘেরা, যাদের চোখে এখনো ভয়, দ্বিধা, সংখ্যার জট।
প্রতিবার ক্লাস শুরু করার আগে সে বোর্ডে বড় করে লেখে-
“শেখা মানে শুধু মুখস্থ নয়, দেখা-বোঝা-মনে রাখা।”
দূর থেকে হয়তো সৌরূপ স্যার দেখছেন, তার এক ছাত্রি নিজের মতো করে ছড়িয়ে দিচ্ছে সমীকরণের আলো।
একদিন যেমন তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন-একটি শিশু-হৃদয়ে জাগিয়ে তুলেছিলেন আত্মবিশ্বাসের প্রথম সূর্যকিরণ।
শিক্ষকের ছোঁয়ায় অন্ধকার ভেদ করে ওঠা সেই আলোই তুষ্টির জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সমীকরণ।
আজ সে জানে
-একজন শিক্ষক মানে শুধু পাঠদান নয়, একজন শিক্ষক মানে-একটা জীবনকে আলোর পথে ফেরানো।





















































