রায়হান আহমেদ তপাদার »
বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে ছোট্ট সবুজ শ্যামল ভূখ-ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। স্বাধীন হওয়ার পর একে একে ৪৯ টি বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তুু আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড রাঙ্কিং তালিকায় শতকের মধ্যে স্থান করে নিতে পারেনি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণে বিভিন্ন সময়ে সরকারগুলো কম-বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার কারণে কিছুটা অগ্রগতি হলেও কাক্সিক্ষত বা আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছায়নি। শিক্ষা জাতির মেরুদ- তাই জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-গবেষণা ছাড়া কোন জাতি এগুতে পারে না। একুশ শতক বিশ্বায়নের যুগ, কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে মূলত সেই দেশের উচ্চশিক্ষার মানের ওপর। বিশ্বে এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগ শুরু হয়েছে, মানসম্মত গবেষণা ও বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে পিছিয়ে থাকলে অন্যের উৎপাদিত পণ্যের ফেরিওয়ালা হয়েই খুশি থাকতে হবে, তাই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে প্রযুক্তি ও জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। বিশ্বায়নের এ যুগে গুণগত শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনা। শিক্ষাই যেহেতু একটি দেশের উন্নয়ন বা আধুনিকায়নের চাবিকাঠি সে কারণে এ ক্ষেত্রটি জাতির নিকট সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
আমরা আশা-নিরাশার দোলাচলে আছি। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান আছে।এই ৫০ বছরে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হয়েছে, মাথাপিছু গড় আয়, গড় আয়ু বেড়েছে, বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। কিন্তু স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের যে চার মূলনীতি সংবিধানে স্থান করে নিয়েছিল, সমাজে ও রাষ্ট্রে তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
কালের পরিক্রমায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন যেখানে এসেছে, তাতে এটা মানতেই হবে যে অনেক ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই। শতবর্ষের বিভিন্ন পর্যায়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতা বদলে গেছে। শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারত, আজ তা দিতে পারছে না। একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুবই সীমিত থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক চাপ নিতে হয়েছে। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের ওপর প্রভাব ফেলেছে। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে জাতির প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ঘাটতি দেখা গেছে। তবে এখন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমাচ্ছে। কিন্তু এরপরও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করাই এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঔপনিবেশিক আমলে এ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা অবকাঠামো। এ অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় এই বিশ্ববিদ্যালয় অসামান্য অবদান রেখেছে। এ দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষা বিলিয়ে গেছে, মানবসম্পদ তৈরি ও উন্নয়নে ভূমিকা পালন করেছে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরুতে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল এক-দুজন, সেখানে আজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সমান সমান। নারী জাগরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অসামান্য। এ অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি, মানবাধিকার, ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম-সব ক্ষেত্রেই এর ভূমিকা রয়েছে।
তাছাড়া বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বিকাশ ও অগ্রযাত্রার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি বাধা। বিভাগগুলোকে পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু ইনস্টিটিউট রয়েছে, সেগুলোকে তার মূল ভূমিকায় ফিরে যেতে হবে। এখন ইনস্টিটিউট ও বিভাগগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ইনস্টিটিউটগুলোর শুধু মাস্টার্স আর এমফিল ডিগ্রি দেওয়ার কথা। তা ছাড়া কিছু বিভাগকে যেখানে এক করা প্রয়োজন, সেখানে বিগত সময়ে সেগুলোকে ভাগ করে নতুন বিভাগ তৈরি করা হয়েছে। তা ছাড়া বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে। পরীক্ষা পদ্ধতিতেও সমস্যা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ও বার্ষিক পদ্ধতির পরীক্ষা, দুটিই কার্যকর রয়েছে। এগুলো বড় সমস্যা তৈরি করছে। শিক্ষা উপকরণ, পরিবেশ ও অবকাঠামো শিক্ষার্থীদের তুলনায় নগণ্য। সিটের অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা কীভাবে থাকেন, তা আপনারা সবাই জানেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন একটি দায়িত্বশীল ও লক্ষ্যমুখী প্রশাসন। ভিশন ও মিশন ঠিক করে এগোতে হবে। বিশ্ব রাঙ্কিংয়ে জায়গা করে নেওয়ার চেয়েও বড় কাজ হচ্ছে জাতীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী ভূমিকা রাখবে, তা ঠিক করা। উন্নয়ন অবকাঠামোর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
তা ছাড়া শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। আমাদের একাডেমি ক্যালেন্ডার করা হয়, কিন্তু তা মেনে চলা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় আইন কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত, কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা হয় না। আমরা নানা ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করি, সাংঘাতিক অনিয়মকে গ্রহণ করি। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতির পথে বড় বাধা। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব একটি পুরোনো সমস্যা। রাজনৈতিক ক্ষমতা সব সময়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দখল করার চেষ্টা করেছে। এ বাস্তবতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ক্ষতি করেছে। বলা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য এ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাই দায়ী। শিক্ষকদের রাজনৈতিক আদর্শ থাকতে পারে। পেশাদারি মনোভাব ও শিক্ষকতাকে অগ্রাধিকার দিলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা হচ্ছে না।বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দ করা সামান্য অর্থও ব্যয় করা যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে গবেষণার প্রতি এ অনীহা কেন? কারণ গবেষণার জন্য বরাদ্দই থাকে না। আমরা তো গবেষণার অর্থের জন্য হাহাকার করি। আপনি যে অভিযোগ করলেন, তা গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি তহবিল রয়েছে। একটি নিজস্ব আয় ও অন্যটি সরকারি বরাদ্দ। এখন এ দুটিকে এক করে ফেলা হয়েছে। আমাদের নিজস্ব তহবিলের অর্থ হিসেবে নিয়ে সরকার বাজেট বরাদ্দ করে। সেই বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়। নিয়মিত পড়াশোনার খরচেই সেই অর্থ চলে যায়। গবেষণার জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এমনকি জাতীয় পর্যায়ে আমরা সব সময় শুনে আসছি যে অর্থ কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু শিক্ষা বা গবেষণায় বরাদ্দের সময় অর্থের ঘাটতি দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক পর্যায়ে বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। দেখা যায়, শিক্ষা সংক্রান্ত পরিকল্পনায় শিক্ষকদের কোনো ভূমিকা নেই। যাঁরা এসব দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা প্রশাসনিক দৃষ্টিতে বিষয়গুলো দেখেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শাসন করতেই যেন বেশি আগ্রহী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও ঘাটতি রয়েছে। ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম প্রসারের নামে ভারাক্রান্ত করেছে। যেখানে খরচ করার কথা, সেখানে না করে করা হয়েছে ভিন্ন খাতে। লোক নিয়োগ করা হয়েছে বেশি। অনেকে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলেছে। উন্নয়নের নামে স্বজনপ্রীতি হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।এমনকি দলীয় রাজনীতির কুফল হিসেবে অনেক কিছুই চেপে বসেছে। শিক্ষক সমিতিকে কমিটির সবার মত নিয়ে অবস্থান নিতে হয়। ভিন্নমত পোষণকারীদের টার্গেটে পরিণত করা হয়। অদৃশ্য প্রতিকূলতায় পড়তে হয়, ফলে অনেকে ভয় পান সাহস করে কিছু বলতে। এ পরিস্থিতি এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। যথাযথ ভূমিকা ও অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে সমিতির যে ভূমিকা পালন করা উচিত, বাস্তব পরিস্থিতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে তা করা যাচ্ছে না।
জাতির প্রত্যাশা হলো আন্তর্জাতিক পরিম-লে উচ্চশিক্ষার গুণগতমানে সকল শঙ্কা, দৈন্যতা, নেতিবাচক ধারণা ও ইমেজ সঙ্কট কাটিয়ে মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাঙ্কিং তালিকা থেকে ছিঁটকে না পড়ে বাংলাদেশের অন্তত দু’চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং তালিকায় শতকের মধ্যে স্থান করে নেবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সেকেলের অগোছালো নৈতিকতা বর্জিত শিক্ষা পদ্ধতি ও গবেষণাবিহীন বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়নে পিছিয়ে পড়েছি আমরা। বৈশ্বিক পরিম-লে উচ্চশিক্ষার মানের দিক দিয়ে ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। এক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ২৯তম ও ৪০তম। এটি সত্যিই উদ্বেগজনক চিত্র। শিক্ষার মানের চিত্রটা আসলে কী, এ প্রশ্নে উদ্বিগ্ন দেশের জনগণ, শিক্ষাবিদ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা, এমনকি খোদ শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকার প্রধানও। অধিকাংশের ধারণা হচ্ছে, শিক্ষায় সংখ্যাগত বিস্তৃতি ঘটলেও প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার নামে বিরাজ করছে অরাজকতা। শিক্ষার মান বিচারে এশিয়ার সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। আর বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিক পরিম-লে উচ্চশিক্ষার গুণগতমানের অবস্থা তলানিতে। বর্তমানে অনেক পরিবর্তন আসছে এটা স্বীকার করতেই হবে যা আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বিগত ৫-৭ বছর পূর্বেও ছিলনা। বর্তমানে
চালু হলেও কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অসহযোগিতা ও প্রতিবন্ধকতার কারণে সে ভাবে কার্যকর নয়। যদি এই আইকিউএসিকে সফলভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়, তাহলে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাস্তবমুখী আন্তর্জাতিকীকরণ ও মানসম্মত উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স