টেকনাফ
জিয়াবুল হক, টেকনাফ >>>
টেকনাফ উপজেলায় পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে বসবাস করছে দুই লাখ মানুষ। গত কয়েকদিন ধরে প্রবল বর্ষণ এ আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিগত কয়েক বছর টেকনাফ উপজেলায় পাহাড়ধসে অনেক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
গত ৫ জুন দুপুরে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চাকমারকূল রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাহাড়ধসের ঘটনায় ব্লক-এর বাসিন্দা শাকেরের বসতঘর মাটি চাপা পড়ে। এসময় তার স্ত্রী নুর হাসিনা (২০) চাপা পড়ে মারা যায়।
বার বার প্রাণহানি এবং প্রশাসনের সতর্কতা সত্ত্বেও পাহাড়ের পাদদেশ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের সরিয়ে আনা যাচ্ছে না। বর্তমানে টেকনাফের ১৩টি ও মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে কয়েক হাজার পরিবার মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বছরের পর বছর বসবাস করে আসছে।
চলতি বর্ষা মৌসুমের পূর্বে পাহাড়ধসের আশঙ্কায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের নিরাপদ এলাকায় সরে যেতে বলা হলেও কেউই শুনছেন না প্রশাসনের সতর্কবাণী। গত দুই দিন ধরে টানা প্রবল বর্ষণে টেকনাফ উপজেলার অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। পাশাপাশি পাহাড়গুলোর বিভিন্ন জায়গায় ফাঁটল ধরার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী সরানোর কোন ব্যবস্থা হয়নি।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, চলতি বর্ষা মৌসুম শুরুতেই ইতোমধ্যে পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কা থাকায় স্থানীয় প্রশাসন এসব পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দিয়েছেন। বেশি ঝুঁকিতে থাকা পরিবারকে স্থানীয় সাইক্লোন শেল্টার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থান করে দেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে চিহ্নিত ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরত বাসিন্দাদের উচ্ছেদে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল উপজেলা প্রশাসন। কিন্ত তা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। বর্ষা এলেই টেকনাফে পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষেরা মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ে। তারপরও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে দুই লাখ মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে। গত দুই দিনের টানা বর্ষণে টেকনাফে পাহাড়ধস নিয়ে বাড়ছে আতঙ্ক। কয়েক হাজার পরিবার পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের কম্পিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট পারফরমেন্সের (সিডিএমপি) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে শুধু বর্ষণের কারণে নয়, ভূমিকম্পেও পাহাড় ধসের ব্যাপক জানমাল ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয় টেকনাফে পাহাড়গুলোর মধ্যে ১৩টি পাহাড় ও রোহিঙ্গাদের পাহাড়ের উপরে ঝুপড়ি ঘর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। যেসব পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস সেগুলো হচ্ছে- টেকনাফ পৌরসভার পুরাতন পল্লানপাড়া, ফকিরামুরা, কাদিরঘোনা, নাইট্যংপাড়া, শিয়াইল, ঘোনা, চাইল্লাতলী, বরইতলী উঠনি, সদর ইউনিয়নের বরইতলী, কেরুনতলী, নতুন পল্লানপাড়া, মাঠপাড়া, জাহালিয়াপাড়া, চন্দরকিল্লা, রাজারছড়া, হাবিরছড়া, মিঠাপানিরছড়া, হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া, জাদিমুরা, রঙ্গিখালী, মুরাপাড়া, পশ্চিম সিকদারপাড়া, মইন্যার ঝুম, ঘোনাপাড়া, পশ্চিম পানখালী, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের দৈংগাকাটা, লাতুরীখোলা, হরিখোলা, রইক্ষং, নয়াপাড়া, কম্বনিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া ও পশ্চিম কুতুবদিয়াপাড়া, আমতলী ইত্যাদি। এসব পাহাড়ে বালির পরিমাণ বেশি। বৃষ্টির সময় বালিতে পানি ঢুকে নরম হওয়ার পর ধসে পড়ে। বৃষ্টি ছাড়া ভূমিকম্পেও যে কোনো মুহূর্তে পাহাড়গুলো ধসে পড়তে পারে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালের ১৫ জুন কক্সবাজারের টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসে ৫৮ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে টেকনাফেই মারা যায় ৩৪ জন। ২০০৮ সালের ৪ ও ৬ জুলাই টেকনাফের ফকিরা মোরা ও টুইন্যার পাহাড় ধসে একই পরিবারের চারজনসহ ১৩ জন মারা যায়। এসময় ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে অর্ধশতাধিক বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত ও শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু আহত হয়েছিল।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দাবি করেন, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত বেশিরভাগ লোকজন দরিদ্র শ্রেণির। আবার অনেকে মিয়ানমার পালিয়ে এসে বসবাস করছে। সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপ নদীর ভাঙনের শিকার হয়ে ভিটেবাড়ি হারানোর পর এক প্রকার বাধ্য হয়ে পাহাড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও তারা বসবাস করে আসছে। এসব পরিবারকে উচ্ছেদ না করে পুর্নবাসনের আওতায় এনে বিকল্প ব্যবস্থা করার দাবি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজ চৌধুরী জানান, টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিরাপদ এলাকায় সরে যেতে বলা এবং সতর্ক করা হয়েছে।