নিজস্ব প্রতিবেদক »
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএর অনুমোদন ছাড়াই নগরের পাহাড়ের কোল ঘেষে পাহাড়ি টিলায় এক থেকে তিন তলা বেসমেন্টসহ (পার্কিং এরিয়া) বহুতল ভবন গড়ে তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ধরনের ভবন নির্মাণের ফলে বির্পযয়ের শংকা যেমন আছে তেমনি মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে পরিবেশ। ভূগর্ভস্থ স্তর বিপন্নের পাশাপাশি সুপেয় পানির উৎস নিঃশেষের মাধ্যমে এ নগরী মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকির কথা বলছেন পরিবেশবিদেরা।
সরেজমিনে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী ও শেরশাহ এলাকায় গড়ে ওঠা পাহাড়ি আবাসিক, সাংবাদিক হাউজিং সোসাইটি, নাগরিক সোসাইটিসহ আকবর শাহ, খুলশী এলাকার বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে দেখা যায়, বিশাল আকারের পাহাড় কেটে সমতল করে গড়ে তোলা এসব আবসিক এলাকায় সিডিএ-র অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই কেউ কেউ পাহাড়ের মাটি কেটে নিজেদের ইচ্ছেমতো বহুতল ভবন এবং দুই-তিন তলা পর্যন্ত বেসমেন্ট রেখে ভবন নির্মাণ করছে।
সিডিএ সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ের গায়ে গড়ে তোলা ভবনের ক্ষেত্রে কোনো বেসমেন্ট রাখার বিধান নেই এবং এলাকাভিত্তিক পাহাড়ের কাঠামো ও অবস্থান বিবেচনায় সেখানে নিদিষ্ট পরিসরের বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘হিলি এরিয়াতে (পাহাড়ি এলাকায়) কোনো বেসমেন্ট দিই না আমরা। বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন কোথাও পাহাড়ের স্লোপ (ঢাল) থাকলে সেখানে এক তলা পর্যন্ত সেভ বেসমেন্টের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু পাহাড়ের কিনারায় কোনো বেসমেন্ট হয় না। অন্য কোনো রকম বেসমেন্ট দিই না।’
পাহাড়ে বহুতল ভবন নির্মাণের বিধিবিধান সম্পর্কে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘এটা পাহাড় অনুযায়ী, মানে রাস্তার উয়িডথ (প্রশস্ততা) মানে জায়গার পরিমাণের ওপর ডিপেন্ড (নির্ভর) করে অনুমতি দেওয়া হয়। যেমন ১০০ ফুট রোড হলে সেটার জন্য একটা নিয়ম, ৬০ ফুট রোড হলে সেটার জন্য একটা নিয়ম। শেরশাহ পাহাড়ে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ২৫ ফুট রাস্তার জন্যে সর্বোচ্চ ৯-১০ তলা পর্যন্ত ফ্লোর নির্মাণ করা যাবে।’
এভাবে প্ল্যান বহির্ভূত নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে সিডিএর পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে অভিযোগ পেলে যেগুলো রানিং কাজ চলছে এবং যারা ডেভিয়েশন করছে, প্ল্যান মোতাবেক করছে না, তাদেরকে জরিমানা করছি, অবৈধ নির্মাণ ভেঙে দিচ্ছি।’
পাহাড় কাটা বন্ধে সক্রিয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) চট্টগ্রামের নেটওয়ার্ক মেম্বার আলিউর রহমান পাহাড়ে খেয়াল খুশিমতো ভবন নির্মাণে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব এবং এ ব্যাপারে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বিষয়ে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে পাহাড়ে আবাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এটা। ধরুন, এখানে বেসমেন্ট পার্কিং রাখার বিধান হচ্ছে এক তলা সেখানে অনেকেই দোতলা, তিন তলা পর্যন্ত করে ফেলছে। তারপর বিল্ডিং (ভবন) আছে পাঁচ তলা সেখানে ছয় তলা করে ওপরে একটা চিলেকোঠা করে। তারপর বাইরে যে জায়গা খালি রাখার কথা সেটা নিচের তলায় খালি রেখে ওপর থেকে আবার রাস্তার সমান নিয়ে আসে। এ সমস্ত কাজ করার কারণেই একদিকে চট্টগ্রাম শহরের যে স্বাভাবিক সৌন্দর্য সেটা নষ্ট হচ্ছে এবং ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। কারণ যে ভবনটা সিডিএ এক তলা হিসেবে বেসমেন্ট প্ল্যান দিয়েছে সেটা তিন তলা করা মানে মাটির নিচে আরো ২৪ ফুট ভিতরে চলে যাওয়া। আর এতে করে প্রথমত ভূগর্ভস্থ স্তর ধ্বংস হচ্ছে এবং বিল্ডিংয়ের যে ধস সহ্য করার ক্ষমতা সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অবাক বিষয় হচ্ছে, এসব বিষয়ে পরীক্ষা করারও কেউ নেই। কারণ বিষয়টাতো ওইসব স্থানে বসবাসকারীরা সিডিএ বা সংশ্লিষ্ট কাউকে জানায় নি। এ সমস্ত কারণে চট্টগ্রাম শহরে বহু ভবন ধসে পড়ার আশংকা রয়েছে। এটা যদি হয় তাহলে ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমরা কাজ করেছি, যেমন নাগরিক সোসাইটি নামক আবাসিক এলাকার অনেকগুলো ভবনে সংশ্লিষ্ট মালিকপক্ষ এক তলা বেসমেন্টের জায়গায় তিন তলা করেছে। এগুলোতে সম্প্রতি সিডিএ গিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। সিডিএর কাজটাই হচ্ছে একটি ভবন পুরোপুরি হওয়া পর্যন্ত তা তদারকি করা। কিন্তু তারা প্ল্যানটা অনুমোদন দিয়ে আর কোনো তদারকি করে না, ফলে যে যার যার খুশি মতো ভবন নির্মাণ করছে। এর পুরো দায়টা হচ্ছে সিডিএর। যারা একতলার পরিবর্তে দুই-তিনতলা পর্যন্ত বেসমেন্ট গড়ে তুলছে এদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রয়োজনে ভবনগুলো ভাঙতে হবে।’
এক্ষেত্রে বেলা’র কার্যক্রম সম্পর্কে আলিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে এ বিষয়ে তথ্য উপাত্তসহ লিখিত অভিযোগ করলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সিডিএকে দিয়ে ওই ভবনে কাজ চলমান থাকলে কাজ বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করি এবং যেটার কাজ হয়ে গেছে সেটা ভাঙার জন্য প্রক্রিয়া করি। সেই জমি যদি সরকার থেকে লিজ দেওয়া হয়, স্থায়ী লিজ সেক্ষেত্রে আমরা লিজ বাতিলের জন্যে কাজ করি।’
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মুক্তাদির হাসান বলেন, ‘ভবনের ক্ষেত্রে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সিডিএ-কে একটা নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ হিসেবে তৈরি করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে ভবনের ডিজাইনে যদি ব্যত্যয় ঘটে সেক্ষেত্রে আমাদের আসলে কিছু করার থাকে না। আমরা করতে পারি যদি শ্রেণিটা পুকুর হয়, পাহাড় হয়, তাহলে ওইটার উপরে যদি অবৈধ স্থাপনা করা বা পাহাড়টা কর্তন করা হচ্ছে এমন অভিযোগ পেলে বা আমাদের পরিদর্শনে জানতে পারি তাহলে আমাদের বিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি।’
জানা যায়, চার দশক আগে চট্টগ্রামে ২০০টির বেশি পাহাড় ছিল, তার মধ্যে ১২০ টির বেশি পাহাড় বিলুপ্ত হয়েছে। আর যেগুলো অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলোর এভাবে যথেচ্ছ এবং অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এ নগরের পরিবেশকে এক মারাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দেবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ মেসবাহুজ্জামানের এক গবেষণায় বলা হয়, পাহাড় হচ্ছে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার খুঁটির মতো, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার পাশাপাশি মানুষ এবং জীব-বৈচিত্র্যের সুপেয় পানির আধার বলা যায়। ক্রমাগত পাহাড় ধ্বংস হয়ে গেলে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম মরুভূমিতে পরিণত হবে। এছাড়া অতিরিক্ত পাহাড় বিলুপ্ত হওয়ায় ইট-কংক্রিটের সৃষ্ট উত্তাপ পরিশোধন করার বিকল্প না থাকায় নগরের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যাবে।