অর্ণব মল্লিক, কাপ্তাই »
পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য- সংস্কৃতি। যেগুলো তারা বহুবছর ধরে লালন করে আসছে। ঠিক তেমনি পাহাড়ে বসবাসরত মারমা সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যবাহী নান্দনিক ঘর রয়েছে। যেগুলো সাধারণত মাচাং ঘর নামেই বেশ পরিচিত। তিন পার্বত্য জেলার শহর এলাকাতে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসব ঘরের দেখা না মিললেও এখনো বিভিন্ন পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে এসব ঘরের দেখা পাওয়া যায়।
মাচাং ঘরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঘরগুলো সাধারণত তৈরি হয় ছন দিয়ে। ছনের মাচাংগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি শীতল, আকর্ষণীয় ও আরামদায়ক। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছন দিয়ে মাচাং ঘর তৈরি করে এখনো অনেক পরিবার বসবাস করে আসছে। এসব মাচাং ঘর গুলো দেখলেই মনে হবে কোন শিল্পীর নিপুন হাতে আঁকা নকশার আদলে তৈরি করা হয়েছে। এই ঘরগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে। পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠা ছোট ছোট পাড়া গুলোতে গুচ্ছবদ্ধভাবে দেখা যায় এসব মাচাং ঘর।
মাচাং ঘরের ঐতিহ্য হিসেবে আরো জানা গেছে, আদিকাল থেকে পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারগুলো বন্যপশু ও জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মাচাং ঘরে বসবাস করত। মাচাংগুলো সাধারণত মাটি থেকে ৫-৬ ফুট উঁচুতে তৈরি করা হতো। আর মাচাং তৈরির একমাত্র উপকরণ ছিল পাহাড়ি ছন ও বাঁশ। তাই একসময় পার্বত্যাঞ্চলে ছনের ব্যাপক কদর ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তন ও জুম চাষের ফলে ছনের উৎপাদন কমে যাবার কারণে হুমকিতে আজকাল জঙ্গলে বাঁশ-ছনের দেখা পাওয়া যায় না। বাজারে কিনতে পাওয়া বাঁশের দাম অনেক বেশি, তাই এখন মাচাং ঘরের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে।
মাচাং ঘরে দীর্ঘদিন বসবাস করে আসছে কাপ্তাই উপজেলার চিৎমরম ইউনিয়ন এর চাকুয়া পাড়ার বাসিন্দা হ্লালা চিং মারমা, মংসাই মারমা সহ অনেকেই। তারা বলেন,
সম্পূর্ণ বাঁশ, গাছ আর ছন দিয়েই তৈরি হতো মাচাং ঘর। ঘরের মূল খুঁটিগুলো হয় গাছ দিয়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় বাঁশেও খুঁটি তৈরি হয়ে থাকে। মাচাং এর সাথে খুঁটির যে সন্ধি বা সংযোগ রয়েছে, সেগুলো বাঁধাই করা হতো বাঁশের বেত দিয়ে। অল্প বয়সী কঁচি বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় এই বেত। বাড়ির মাচাংকে ধরে রাখতে মাচাংয়ের সমান্তরাল বাঁশের সঙ্গে খুঁটির প্রত্যেকটি সন্ধিতে মাটি থেকে দেওয়া হতো ঠেঁস। কাঠ, বাঁশ আর ছন দিয়ে তৈরি মাচাং ঘরের তেমন আর দেখা মেলে না। বাঁশ, বেত আর খুঁটির দাম বেশি হওয়ায় মাচাং ঘরের প্রতি অনেকের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
তবে কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়ন এর বাসিন্দা সামাপ্রু মারমা, রেমেচিং মারমা সহ অনেকেই বলেন, মাচাং ঘর আমাদের ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনে এটি বর্তমানে কমে আসলেও এখনো মাচাং ঘরের প্রতি অনেকের ভালোবাসা রয়েছে। তাই অনেকেই এই ঘরে বসবাস করে থাকেন। তবে মাচাং ঘরের একটা সমস্যা হচ্ছে এই ঘর তৈরিতে বর্তমানে ২ থেকে ৩ লক্ষ টাকা খরচ হয় কিন্তু ঘরগুলো ২-৩ বছরের বেশি টিকে না। তাছাড়া বনজঙ্গলে প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে প্রচুর গাছ-বাঁশ। তাই খরচ একটু বেশি হলেও স্থায়িত্বের কথা ভেবে অনেকেই ইট-পাথরের ঘর তুলতে আগ্রহী হয়ে যাচ্ছেন। তবে বিভিন্ন সমস্যা হলেও এই মাচাং ঘর আমাদের সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য। তাই আমাদের এই মাচাং ঘরের সংস্কৃতি হারাতে দেওয়া যাবেনা। এই ঐতিহ্য আমাদের ভবিষ্যতেও টিকিয়ে রাখতে হবে।
প্রসঙ্গত, বিগত সরকারের আমলে পাহাড়ের এই মাচাং ঘরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার প্রায় ৪০টি পরিবারকে বিনামূল্যে মাচাং ঘর উপহার দেওয়া হয়েছে। যেই ঘরগুলোতে বর্তমানে পরিবারগুলো বসবাস করছে।