আজহার মাহমুদ »
আমার কাছে হালকা চা-পাতা হলেই চলে। পানিটা হালকা রং করে চিনি মিশিয়ে বেশ ভাব নিয়ে খাই। সবসময় তো খাওয়া সম্ভব নয়, যখন পাই তখন মনে হয় অমৃত খাই। মাঝে-মাঝে চিনিও জুটে না। তখন ভাব করি ডায়বেটিস হয়েছে আমার। তাছাড়া একটু তেতো হলেও এভাবে খেতে পারাটও একটা ভাবের। আমার চাপানের এই অংশটা তোমার কাছে নিখাদ হাস্যকর লাগবে। কারণ এসবের কোনোটাই তোমার পছন্দ না। তুমি মাঝেমধ্যে মালাই চা খাও আর বেশির ভাগ সময় কফি কিংবা গ্রিন টি খাও। গ্রিন টি মানে সবুজ চা বুঝি আমি। তাহলে আমি রেড টি খাই নিশ্চয়। কারণ আমার চায়ের রং লাল।
যাই হোক, পার্থক্য শুধু এই একটা আছে তা কিন্তু নয়। আমি আজ আমাদের পার্থক্য নিয়েই তোমাকে লিখছি। তুমি যে-গাড়িতে করে আসো, সেই গাড়িটিতে আমি আমার জন্মের পর কখনও বসিনি। তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার সুবাদে বসা হয়েছে কয়েকবার। তুমি হয়তো খেয়াল করেছো আমি কতটা নার্ভাস ছিলাম তোমার গাড়িতে যেদিন প্রথম বসেছিলাম। যেদিন তুমি গাড়িতে করে আসো না সেদিন হয়তো সিএনজি, নয়তো বেশি দামে রিকশায় করে হওয়া খেতে খেতে বাসায় যাও। লোকাল গাড়ি তোমার দু-চোখের বিষ। তুমি লোকাল গাড়িতে করে যাবা, এটা যেমন ভাবতে পারো না, আমিও তেমনি এতো দামি গাড়িতে বসবো, ভাবতে পারি না।
আমাদের পার্থক্য কত নিখুঁত দেখেছ? তুমি কলেজে প্রায় নতুন-নতুন জামা পরে আসো। আমার মনে হয়, আমার সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকে এটা কিছুটা কমিয়ে দিয়েছ। কিন্তু তোমার জামাগুলো এতো সুন্দর, এতো পরিষ্কার, মাঝে-মাঝে তোমার জামাগুলোকেও ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। আর তুমি নিজেও শুনেছ কলেজে আমার জামা নিয়েও ছেলেমেয়েরা কথা বলে। এটা নিয়েও হাসাহাসি হয়। তুমি আমার জন্য জামা কিনেছিলে। আমি নিইনি। হয়তো সেজন্য কষ্ট পেয়েছিলে। তবে আমি আমার তৃতীয় শার্টটিও নিজের টাকায় কিনতে চেয়েছি। এখনও সেই শার্ট কেনা হয়নি। দুই শার্ট নিয়ে কলেজের দুই বছর মোটামুটি পার করে দিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না আমার। অথচ তোমার এবং তোমার বন্ধুদের আমার শার্ট নিয়ে অনেক সমস্যা ছিল। এই পার্থক্যটুকুও কোনো রকম হালকাভাবে নেয়া যাবে না।
আমার জামা নিয়ে একটা গল্প আছে। আজ তোমাকে সেটাও একটু জানাই। কখনও এটা বলা হয়ে ওঠেনি তোমাকে। তুমি তো জানো, আমরা চার ভাই এক বোন। আমার বড়ভাই আর আমি যখন হাই স্কুলে পড়ি তখন আমাদের দুই ভাইকে একটা-একটা সাদা শার্ট কিনে দেয় বাবা। এই ঢাকা শহরে এতজন মানুষকে নিয়ে এই সংসরাটা বাবা কীভাবে চালায়, সেটাও তোমার অজানা নয়। বাবা যেদিন শার্ট এনেছিল সেদিন বাজার আনেনি। বাবা বলেছিল, না খেয়ে হলেও আমার ছেলেদের আমি পড়াবো। সেদিন মা একটা ডিম ভেজে সেটাকে ৭ টুকরো করে তারপর ডাল দিয়ে খাওয়া হয়েছে। মা আবার আমাদের না খাইয়ে ঘুমোতে দেন না রাতে। জমজ হওয়াতে বাবার আমাদের দুজনের খরচ চালাতে হিমশিম খেতেন। রিকশা চালিয়ে আর কত পারা যায়? ঘরভাড়া, খাবার, জামা-কাপড়, পড়াশোনা, চিকিৎসা সবকিছুই তো করছেন। মাঝে-মাঝে চিন্তা করি, কীভাবে বাবা এটা পারেন? বাবার মুখ দেখলেই বোঝা যায় বাবা সেটা কতটা কষ্টে পারেন। যা হোক আমরা দুই ভাই ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই। ভর্তির টাকা কিছু মওকুফ করে দিলেও বেশির ভাগ টাকা দিতে হচ্ছে। বাবা ভর্তির টাকাগুলো অনেক কষ্টে জোগাড় করেছিল। দুজনের সাদা শার্ট নতুন ছিল। নতুন জামা পরে স্কুলে যেতে বেশ ভালো লাগছিল। আমার বড়ভাই একটু শান্ত হলেও আমি ছিলাম সামান্য দুষ্টু। আমার সাথে দুষ্টুমি করে একটা ছেলে কলম দিয়ে আমার শার্টে দাগ দেয়। আমিও তার শার্টে দাগ দিয়ে হিসেব সমান করলাম। কিন্তু ছেলেটা আবারও দাগ দেয় আমাকে। এভাবে দাগ দেওয়ার খেলা খেলতে-খেলতে দুজনের শার্ট কলমের কালিতে ভরপুর হয়ে যায়। আমার ভাই বাসায় গিয়ে সবকিছু আম্মুকে বলে দেবে। আমি ভয়ে-ভয়ে বাসায় গেলাম। বাসায় গিয়ে মায়ের বকা খেয়েছি, রাতে বাবার পিটুনি খেয়েছি। আমার শার্টভর্তি এমন দাগ বাবা কোনোভাবেই নিতে পারেনি। নতুন জামা, তার ওপর অনেক কষ্টের টাকা। এই একটা শার্ট দিয়ে আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি। আমার শার্টের পেছনে কালো দাগ থাকতো। খুব লজ্জা লাগতো। তবুও স্কুলে যেতে হতো। এরপরের গল্পগুলো আর বলতে ইচ্ছে করছে না। ভাতের সাথে মাংস না থাকলে তোমার হয় না। মাঝে-মাঝে আমাকে দেখানোর জন্য তুমি সবজি দিয়ে খেতে। কিন্তু কতটুকু খেতে সেটাও আমি দেখতাম। অথচ তুমি জানো, আমি শুধু ডাল দিয়েই দু-চার প্লেট ভাত খেয়ে নিতে পারি। বিকেলে তোমার নাশতায় বার্গার কিংবা পিজ্জা থাকে। আর আমার বিকেলের নাস্তা বলতে কিছুই থাকে না। সত্যি বলতে বিকেলে ক্ষুধাও লাগে না।
তোমার বিছানা আর বিছানার জিনিসপত্রের যা দাম তাতে আমাদের বাসার সমস্ত জিনিসপত্র পাওয়া যাবে। আর আমাদের বিছানা হচ্ছে ফ্লোর। আমরা পরিবারের সবাই মিলে সেখানে স্বচ্ছন্দে ঘুমাই। তুমি হয়তো আমাকে দেখানোর জন্য ফেøারেও ঘুমাতে পারো তবে সেটাও তোমার বাস্তবতা নয়। আমার সাথে তোমার পার্থক্য যোজন-যোজন। সামান্য কয়েকটা পার্থক্য থাকলে মেনে নেয়া যেতো। কিন্তু এতো-এতো পার্থক্যের দেয়াল ভেদ করে তুমি আমার হতে চাইলে তোমার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমার মতো মানুষের জন্য তোমাকে ভালোবাসা যায় তবে ছোঁয়া যায় না। তোমাকে আপন ভাবা যায়, কাছে টেনে নেয়া যায় না।
তুমি হয়তো আবেগের বশে আমাকে বিয়ে করতে পারো। কষ্ট করে সব মানিয়ে নিতে পারো। তবে সেটাও বেশিদিনের জন্য নয়। আর সত্যি বলতে আমিও তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার কষ্ট আমি সইতে পারবো না। তাই তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তবে সেটা দূর থেকেই। তোমাকে কাছে রেখে ভালোবাসা আমার জন্য নয়। ইতি …