সুপ্রভাত ডেস্ক »
নতুন স্থাপনা নির্মাণ নিয়ে জেলা প্রশাসন ও আইনজীবী সমিতির দ্বন্দ্বের মধ্যেই চট্টগ্রামের পরীর পাহাড়কে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের প্রস্তাব বিবেচনা করছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
পাশাপাশি পরীর পাহাড়ের ১৩০ বছরের পুরনো দ্বিতল আদালত ভবনটিকে ‘হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
পরীর পাহাড়ে থাকা চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি অফিস এবং নগরীর অন্যত্র থাকা সরকারি দপ্তর মিলিয়ে মোট ৪৪টি সরকারি অফিস যাবে কালুরঘাটে।
সেখানে প্রস্তাবিত ‘সমন্বিত অফিস ভবন নির্মাণ প্রকল্পের’ নকশা চূড়ান্ত হতে পারে চলতি মাসেই। প্রকল্পটির কাজ শেষ হতে তিন-চার বছর সময় লাগতে পারে।
ইতোমধ্যে পরীর পাহাড়ে নতুন স্থাপনা নির্মাণ না করতে এবং অবৈধ স্থাপনা অপসারণ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে তাতে সায় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
পরীর পাহাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা অপসারণ ও সংস্কার বিষয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ২৯ অগাস্ট চিঠি দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
এরপর ৯ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে পরীর পাহাড় গেজেটভুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা কিনা, গেজেটভুক্ত না হলে বর্তমানে ঘোষণার সুযোগ আছে কিনা এবং এই এলাকা সংস্কার ও সংরক্ষণের সুযোগ আছে কিনা সে বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে মতামত চাওয়া হয়।
জানতে চাইলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিশাখা) মো. আতাউর রহমান বলেন, “পরীর পাহাড়ের বিষয়টি ফাইলে দিয়েছি, যেভাবে উপর থেকে সিদ্ধান্ত আসবে সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার যদি মনে করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নেবে, তাহলে নেবে। এটা উপরের সিদ্ধান্তের বিষয়। উপর থেকে ফাইল এলে তখন বিস্তারিত বলা যাবে।”
আর চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশের যে সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে তারই আলোকে প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ আইনের আওতায় আমরা আশা করছি এটিকে (পুরাতন আদালত ভবন) হেরিটেজ ঘোষণা করা হবে। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এই ভবনটির সংরক্ষণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
“হেরিটেজ যখন ঘোষণা হবে, এই এলাকাটি চমৎকার দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে, মানুষ যেন প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে পারে।”
পরীর পাহাড়ের চূড়ায় পুরাতন আদালত ভবনটি নির্মাণ করা হয় ১৮৯৩-৯৪ সালে। পুরনো ভবনটি ভাঙার উদ্যোগ নেওয়া হলে ঐতিহ্য সংরক্ষণের দাবিতে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ আন্দোলন গড়ে তোলে।
পরে ২০১০ সালে পুরাতন ভবনের পিছনে চারতলা নতুন আদালত ভবন নির্মাণ করা হয়। সংস্কারের পর শতবর্ষী পুরাতন আদালত ভবনটি তখন থেকে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
পুরো পরীর পাহাড় হেরিটেজ ঘোষিত হলে আদালত ও সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, “আদালতের কার্যক্রম চলবে। পাহাড়ের কোনো ভবন ও অংশ হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে কি না, সেটা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করবে।”
গন্তব্য কর্ণফুলীর তীরে
বর্তমানে পুরাতন আদালত ভবনে থাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সরকারি ৪৪টি দপ্তর নগরীর কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর তীরে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, একেকটি অফিস একেক জায়গায় থাকার কারণে সরকারি সেবা প্রত্যাশীদের অনেক ভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক সরকারি অফিসের নিজস্ব ভবনও নেই। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে ‘সমন্বিত অফিস ভবন নির্মাণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন।
“এই প্রকল্পে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ ৪৪টি সরকারি অফিষ, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, সার্কিট হাউজ, সরকারি ট্রেনিং সেন্টার, মাল্টি স্টোরিড কার পার্কিং, স্মৃতি সৌধ হবে।”
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। জমি নির্ধারণ করা হয়েছে নগরীর চান্দগাঁও সার্কেলের অধীনে কালুরঘাটে বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির পাশে। সেখানে ৭৩ একর খাস জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
জেলা প্রশাসক জানান, “খসড়া পরিকল্পনা হয়ে গেছে। ২৩ সেপ্টেম্বর নকশা চূড়ান্ত হতে পারে। এরপর ডিপিপি প্রণয়নের কাজ শুরু হবে। আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে চট্টগ্রামের সকল সেবাপ্রত্যাশী একই জায়গায় সব সরকারি সেবা পাবেন।”
সপ্তদশ শতাব্দীতে আরাকানি শাসনে ‘ফেয়ারি হিল’ ছিল পতুর্গিজদের সম্পত্তি। ইংরেজ শাসনামলে হাতবদল হয়ে উনবিংশ শতকের মাঝমাঝি সময়ে তা বাঙালি জমিদার অখিল চন্দ্র সেনের হাতে আসে।
১৮৮৯ সালে অখিল চন্দ্রের কাছ থেকে ‘পরীর পাহাড়’ হিসেবে পরিচিত এই পাহাড় কিনে নেয় ব্রিটিশ সরকার। ১৮৯৩-৯৪ সালে ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে রাইটার্স বিল্ডিং এর আদলে দুই তলা আদালত ভবন নির্মাণ করা হয়।
এই ভবন নির্মাণে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদনকারী সেসময়ের বিভাগীয় কমিশনারের ব্যক্তিগত সহকারী কবি নবীন চন্দ্র সেন আত্মজীবনীতে লিখেছেন, কমিশনার, জজ, কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেটমহ সব অফিসের সমাবেশ ঘটাতে পরীর পাহাড়ে বৃহৎ অট্টালিকা করার প্রস্তাব করেছিলেন তিনি।
সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম