হাফিজ রশিদ খান »
বাংলা ও বাঙালির জীবনে জাতীয় কবি নজরুলের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে নতুন-নতুন নিরিখের গবেষণাগ্রন্থ, প্রবন্ধ-নিবন্ধ নিত্য প্রকাশিত হচ্ছে। সেই এক বিস্ময় জাগানিয়া সৃজনশীল প্রতিভা নজরুল। কবি, কথাসাহিত্যিক, সংগীতকার, সাংবাদিক, পত্রিকা সম্পাদক, এমকি রাজনীতিবিদ ও সৈনিক হিশেবেও বর্ণিল জীবন তাঁর। উপনিবেশ ও উপনিবেশবাদ, ভারতবর্ষীয় ধর্মান্ধতা, সামাজিক কূপম-ুকতা, জাতপাতের বিরুদ্ধে, নারীর অধিকার রক্ষায় স্থবির ও পক্ষাঘাগ্রস্ত সমাজের অন্যায় ও অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন লেখনিতে, অভিভাষণে, সাংগীতিক অভিব্যক্তিতে।
প্রত্যেক বাংলাবর্ষের ১২ ভাদ্রে তাঁকে স্মরণ করা হয়। এদিনে তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় তাঁর শেষ নিশ্বাস পড়ে। এই আগস্ট মাসটা ভারি বিরহবিধুর। মর্সিয়ার মেঘ ভেসে বেড়ায় এখানে, বাংলা ভাষা ও বাঙালির বসতভূমে। ৭ আগস্ট (রবীন্দ্র প্রয়াণ), ১২ আগস্ট (হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু) ১৫ আগস্ট (জাতির পিতার শাহাদাত) ১৭ আগস্ট (শামসুর রাহমানের মৃত্যু) এবং ২৯ আগস্ট (নজরুল প্রয়াণ) আমাদের ঘিরে রাখে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে পরম আত্মীয়বন্ধনে, জাতীয়বোধের শামিয়ানাতলে। ওই বিদেহীরা যেন ক্ষণে-ক্ষণে বলছেন ঘুরে-ঘুরে : বিশ্বভুবনের মুক্ত হাওয়ায়, মাতৃভূমি, মাতৃভাষা ও সার্বভৌমত্বের জীয়নকাঠি এবং দুর্বত্তায়ন ও দুর্বত্তলালনের অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রেখে গেলাম আমাদের বলিষ্ঠ বাণী আর অভিভাবকত্ব। মৌরুসীপাট্টার অলংঘনীয় বিধানের মতো।
নজরুল আমাদের জাতীয় অনুভূতির সারথি। সত্য ও সুন্দরের পথচলাতে আমাদের লাল উত্তরীয়ধারী কা-ারি। যুগে-যুগে তাঁর কবিতা ও গান আমাদের চিত্তশুদ্ধির প্রেরণা। জাতির সকল ধরনের সংকটমোচনে, সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠায় ও লালসাপূর্ণ সামাজিক আধিপত্য নির্মূলে নজরুলের কবিতা-গান আমাদের জন্যে বাইরের ও ভেতরের নান্দনিক পথপ্রদর্শক। তাঁর গান মানে কথা-সুরে ও গায়কীতে নিজস্বতা। মর্ত্যলোকের আলাদা সুবাস। বাংলার কাদামাটি, জলজগুল্ম, শ্যামল দিগন্তের ধূসরাভ মরমিয়ানা। বিরহভাবনা, বিরহযাপন ও বিরহের কাব্যিক প্রকাশও নজরুলের সবিশেষ প্রভাবক কাব্যিকশক্তি।
তাঁর একটি গানে আমার মন মাঝে-মাঝে ডুব দিয়ে থাকে খুব নিঃসঙ্গ মুহূর্তে। ওই গানের সুরেলা কলির ভেতর দিয়ে আমি অনুভব আমার হারানো প্রিয়াকে পাই। তার সমস্তই আমি দেখতে পাই এ গানের অনুরণনে। ও থেকে আমায় বের করে আনে অমন ডুবুরি বিশ্ববিধাতার সৃষ্টিতে নেই। ওই নিমজ্জনের মূলে যে-
গান, সেটির কথা নিম্নরূপ, কানে ওই গানের সুরের মাধুরী রেখে পাঠ করি :
এক
পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে
বলিও আমার পরদেশীরে ॥
সে দেশে যবে বাদল ঝরে
কাঁদে নাকি প্রাণ একেলা ঘরে
বিরহব্যথা নাহি কি সেথা
বাজে না বাঁশি নদীর তীরে॥
বাদল রাতে ডাকিলে পিয়া
ডাকিলে পিয়া পিয়া পাপিয়া
বেদনায় ভরে উঠে নাকি রে কাহারও হিয়া।
ফোটে যবে ফুল, উঠে যবে চাঁদ
জাগে না সেথা কি প্রাণে কোনো সাধ
দেয় না কেহ গুরুগঞ্জনা
সে দেশে বুঝি কুলবতীরে ॥
দুই
নজরুলের অজস্র কবিতা, সহস্র গান। কালজয়ী জাতীয় সম্পদ। ও-সবে এ হৃদয়, এ চেতনা ঘিরে আছে সেই এক রোদেলা, ঝিরঝিরি হ্রদের জলরাশির মতো। মনে বড় ইচ্ছে জাগে, তাঁর এ-গানখানা নিয়ে আমার বেদনারে তাঁর বেদনার কাছে পৌঁছুই। জানি, তাঁর বেদনাভার ভারি মহৎ। তাতে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা সহজ, শরিক হওয়া ততটা দুষ্কর। সে চেষ্টা পাপও। তবু ক্ষুদ্রের স্পর্ধাকে বৃহতে আশকারার চোখে দেখেন, এ বহুলবিদিত সত্য। বেদনা আর বিরহের অমর্ত্যসুন্দর ভাবপ্রকাশে ঋদ্ধির দিক থেকে নজরুল যেমন যোজন ঊর্ধ্বলোকের বাসিন্দা, আবার কেমন যেন খুব কাছের ফেরেশতাও এক। এখানে তাঁকে ঘিরে কাঁদা যায়। তাঁর সামনে ধুলোয় লুটোলে তিনি কি বাড়াবেন না তাঁর বরাভয় হাত! একটুও কি চঞ্চল হবেন না তিনি করুণায় আমার আর্ততার পানে চেয়ে-চেয়ে! গানটি মনোরম কথার সমতালে সুরের মিড়ে-মিড়ে পরদেশি প্রিয়ার প্রতি আকুলতাভরা অপূর্ব
নান্দনিকবোধের স্ফুরণ ঘটায় শ্রোতার
ভেতরে।
বিচ্ছেদের জ্বালার তাপে অন্তর নুয়ে পড়ে বোবাকান্নায়।
সেই পরদেশি কোন্ সুদূরে এখন? কোন্ টলটলে জল পুকুরের ঘাটে নাইতে আসে সে মাঝেমধ্যে? কোন্ সে পুরুষের বধূ হয়ে আছে নিরালা, শ্যামল গাঁয়ে? আত্মজ-আত্মজাসহ কলস্বরা প্রতিবেশিনীযোগে সে কি সুহাসিনী এখনো আগের মতো? সুখের পরশে গরবিনীও কি কিছুটা? কবির দৃঢ় বিশ্বাস, বাদলের বৃষ্টিধারা যখন নেমে আসে আকাশ মাতিয়ে, নিতান্ত কাজের ভিড়েও ‘একেলা ঘরে’ যে-নিঃসঙ্গতা থাকে তা কি একটুও অস্ফুট কান্নার বেগ আনে না ওর হৃদে?
পাশের বনকুঞ্জে পাপিয়া ডাকে। ও ডাক সেই রূপসীরে টলায় না একটুও, ফেলে আসা দিনের স্মৃতিময় টানে? এ গানের গোপন-গভীরে নার্গিস কি জেগে থাকেন, কুমিল্লার দৌলতপুর গ্রাম থেকে যে-রাতে নজরুল তাঁকে ফেলে চলে এলেন একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার বজ্রপাতে? নজরুলের জীবনে এ-নারী গহন প্রেমময়তার ছায়া হয়ে আছেন খুব নিভৃতে। তাঁর বিরহনমিত গানের সাজিতে নার্গিস কেবলই যেন আঁচলের খুঁটে চোখের জল মুছতে-মুছতে চেয়ে থাকা অধরা।
বাংলা গানের বিরল বিরহ অনুতাপে দুই দগ্ধপ্রাণ নজরুল-নার্গিস। ভাষা আর সুর, তারও অধিক কবিত্বের প্রগাঢ় সুষম আবেষ্টনে এ গান চিরব্যথাতুর, চির প্রেমার্ত, চির প্রগল্ভ। কিছুটা এক তরফাও। কেননা সুখিই তো সেই নারী! তাঁর ভালোবাসা বলয়িত হচ্ছে তো সংসারের নবমালঞ্চের সৌরভ-গৌরবে। খালি কবিরই যেন সদা উচাটন মন। বিরহ-ভাবুকতা সন্তাপ হয়ে আংরা করে চলেছে শুধু কবিরই ‘হিয়া’।
চাঁদ উঠলে, ফুল ফুটলে ওই ‘কুলবতী’র ভাবান্তর হবে, আনমনা হবে সে বিগত ভালোবাসার আন্দোলনেÑ এমন ইচ্ছের আহ্লাদে কবির গভীর অভিমান খসে-খসে পড়ে। পরদেশে ‘গুরুগঞ্জনা’মুক্ত নায়িকাটিকে ঈর্ষাও করছেন কবি, এমন আক্ষেপও সুরে-সুরে ভাসে : ‘বেদনায় ভরে উঠে না কি রে কাহারও হিয়া …‘।
এই ‘কাহারও’ তো আদতে কবিপ্রেমবিস্মৃত ওই ‘কুলবতী’ই!
তিন
গানটি তার স্বর্ণাভ আবর্তনে কালিদাসের ‘মেঘদূত’-এর নবনির্মিতির আরেক পরম্পরাও ধারণ করে। প্রেমিক যক্ষ যখন উত্তর মেঘের বাহনে তার প্রেয়সীর কাছে বার্তা পাঠাচ্ছেন দারুণ সব উপমা, দিকনির্দেশনার কাব্যিক কাকুতিতে, এখানেও তেমনি বাঁশিবাজা নদীতীর, নিম্নমুখী বরিষণঋদ্ধ বঙ্গীয় জনপদÑ চোখের জলেরই তুলনা যা। কবি কালিদাস যেখানে আকাশে ভাসেন মেঘমালার মন্দ্রগমন, আবর্তন আর নানা ভয়ার্ত গর্জনের মধ্যে, নজরুল সেখানে মাটির পৃথিবীতে, একটি কুটিরের ‘কুলবতীরে’ সাধেন স্মৃতির বরষামথিত নৈবেদ্য।
চার
উন্মাদসুলভ প্রেমাকাক্সক্ষা, রক্ষণশীল পাঁজরগুলোতে কাঁপনধরা একরৈখিক উদ্দামতা ছাড়া সৃজনশীলতার উলঙ্গ প্রকাশ হয় না। প্রিয় মানুষের মুখে একচিলতে হাসি ফুটাতে, বিপরীতে প্রতিপক্ষের মুখ ম্লান করে দিতে ওই একতরফা তা-ব নৃত্য বড় প্রার্থিত। সভ্যতাও একতরফা ভাবুকতার উন্মাদনারই আবিষ্কার।