হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ জাল্লা জালালুহু সমস্ত গুণগান ও প্রশংসার মূল মালিক, যিনি কুলÑমাখলুকাতের ¯্রষ্টা ও পালনকর্তা। যাঁর হাম্দ দিয়ে পবিত্র কুরআনের বিন্যাস সূচিত। তাঁর পবিত্রতা, যাঁর অবতীর্ণ কিতাব পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারে না। তাঁর কৃতজ্ঞতা, যিনি তাওবাকারী বান্দাদের অপরাধ মার্জনা করেন।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। তিনিই একমাত্র ¯্রষ্টা, পালনকর্তা, রিয্কদাতা। একমাত্র উপাস্যও তিনিই। কোন গুণেই তার সমকক্ষ কেউ নেই। আমাদের মুক্তির কা-ারী, ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে সম্পর্কের সেতুÑবন্ধন, লাÑমকানের মেহমান হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র প্রিয়তম বান্দা ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম রাসূল।
হিজরী বর্ষপঞ্জির একটি মাস শেষ হয়ে আরেকটি মাস সমুপস্থিত। আমরা জুমাদাল উখরার চাঁদকে বিদায় দিয়ে স্বাগত জানাবো আরেকটি মহান মাস ‘রজবুল মুরাজ্বাব’কে। একাধিক বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল মাহে রজব আমাদের কাছে হাজির। বছরের বারোটি চন্দ্র মাসের প্রত্যেকটির রয়েছে স্বতন্ত্র কিছু বিশেষত্ব। পবিত্র কুরআন হাদীসে চারটি মাসকে ‘হারাম’ মাস সাব্যস্থ করা হয়েছে। বারোটি মাসের বিভাজন সে আসমানÑযমীনের সৃষ্টিলগ্ন হতেই স্বীকৃত। তন্মধ্যে চারটি মাস হারাম মাস চতুষ্টয় হিসাবে পরিচিত। তিনটি ধারাবাহিক। (যথা- যিলক্ব’দ, যিলহজ্ব ও মুহাররম)। বাকিটা রজব। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ‘তোমরা এগুলোতে যেন নিজেদের ওপর কোন অনাচার করো না’। (৯:৩৬) ইসলামে মাসগুলোর পবিত্রতার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ‘হারাম’ শব্দটি এখানে ‘সম্মানিত’ অর্থে প্রয়োগ হয়েছে। হালাল’র বিপরীতার্থক অর্থেও এটি ব্যবহৃত হয়। তবে সম্মান, মর্যাদা, ইয্যত এসব শব্দের মধ্যেও নিষিদ্ধতার একটি অর্থ বিদ্যমান। তাহলো, যেখানে সম্মান, মর্যাদা জরুরি সেখানে বিপরীতটা নিষিদ্ধ অর্থাৎ কোনভাবেই এসবের অসম্মান বা অমর্যাদা করা যাবে না। পবিত্র কুরআনের সুরা মায়েদার প্রারম্ভে এ অর্থের স্পষ্টীকরণে বলা হয়েছে, ‘তোমরা হালাল মনে করোনা আল্লাহ্র নিদর্শনাদি, না হারাম মাসগুলোকে। না কুরবানীর পশুগুলো ও (হাদিয়া রূপে চিহ্নিত করণের জন্য) যেগুলোকে কণ্ঠাভরণ পরানো হয়েছে’। (৫:২) বুঝা গেল যেগুলোকে সম্মান করতে নির্দেশ এসেছে, সেগুলোর সম্মান ওয়াজিব। যেগুলো মর্যাদার হকদার, সেগুলোর অবমাননাও নিষিদ্ধ, অর্থাৎ হারাম। কাজেই মাহে রজবের সম্মান, মর্যাদা ও পবিত্রতার প্রতি প্রত্যেক ঈমানদার নরÑনারীকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং এ মাসগুলোর সম্মানার্থে সকল নিষিদ্ধ আমল পরিহার করার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
মাহে রজব মুসলিম মিল্লাতের কাছে অবিস্মরণীয় মর্যাদার। এ মাসে সংঘটিত হয়েছে ‘নবী মুস্তফা, হাবীবে ইলাহ্, সায়্যিদুনা মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ্’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উজ্জ্বলতর মু’জিযাটি সংঘটিত হয়। যা রাসূলুল্লাহ্র প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও তাঁর অকাট্য ‘মু’জিযার যথার্থ মানদ- হিসাবে বিবেচিত। আমরা তাঁকে বিশ্বাস করি সর্বান্তকরণে। তাই তাঁর প্রতিটি মু’জিযাকেও সন্দেহাতীত বিশ্বাসে রাখি হৃদয়ের মাঝে, মনের মণিকোটায়। এ শিক্ষা আমরা পেয়েছি হাবীবে খোদা’র রফীকে গাÑর সায়্যিদুনা সিদ্দীকে আকবার (রাদ্বি.)র জীবন থেকে। আমাদের ঈমান আক্বীদায় আল্লাহ্র হাবীব (দ.) হলেন হায়াতুন্নবী। তিনি নিছক সত্তাগত যিন্দাই নন; তিনি যেমন যিন্দা, তাঁর (দ.) মু’জিযাও যিন্দা। সেগুলোর মধ্যে দু’টি উজ্জ্বলতর মু’জিযার একটি পবিত্র কুরআন, অপরটি মে’রাজ শরীফ। অনেকে নামাযের যেভাবে গুরুত্ব দেন, পবিত্র মে’ রাজের গুরুত্ব সেভাবেই এড়িয়ে যান। এটা কপটতা বৈ কিছু নয়। যে মে’রাজের মাধ্যমে নামায এসেছে, সে মহান মু’জিযাকে অবজ্ঞা করা নিঃসন্দেহে মুনাফিকী। মাআÑযাল্লাহ॥ নামায যে মাসের বিশেষ রাতে পাঁচ ওয়াক্ত রূপে আনুষ্ঠানিক ফরয হয়েছে, তা রজব মাস। এটি যেভাবে মে’রাজের মাস, তেমনিভাবে বলা যায় নামায ফরয হওয়ার স্মরণীয় মাস। মে’রাজুন্নবী হতেই আমরা পেয়েছি নামায, যা মুমিনের মে’রাজ। মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় চেতনা ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত হয় বিশেষ তিনটি মাসে, মাহে রজব, শা’বান ও রমযান। এ ব্যাপকতায় মাসত্রয়কে ইসলামী তাহ্যীবÑতামাদ্দুন’্র বিশেষ প্যাকেজ বলা যায়। প্রতি মাসেই বিশেষ তিনটি রাত আবাল বৃদ্ধ বণিতাকে বিনিদ্র জেগে ইবাদত বন্দেগীর উৎসব পালনে ব্যাপক তৎপর দেখা যায়। যথা শবে মে’রাজ, শবে বরাত এবং শবে কদর। প্রত্যেকটি রাতের স্বাতন্ত্র থাকলেও তিনটি উৎসবের মধ্যে অভিন্ন পূণ্যÑউচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়। তা হলো, ইবাদতের উদ্দীপনা, আত্মার পুলক, সহমর্মিতা, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, পরস্পরে শুভেচ্ছা বিনিময়Ñসবমিলিয়ে ভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রীর বন্ধন ব্যাপক মজবুত হয়। দেশের মানুষের কল্যাণ, সমৃদ্ধি, সংহতি কামনায় মসজিদে, মাযারে, মুসল্লীদের পদচারণায় মুখর পরিবেশ ভিন্নতর অনুভূতিতে উদ্দীপ্ত করে অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মানুষকে। এমন পবিত্র আবহ আমেজের শুভ সূচনা করে মাহে রজব। তাই, ইবাদতের বিশেষ মাসত্রয়ের প্রথম বলা যায় পবিত্র রজবের মাসকে।
বছরের পাঁচটি বিশেষ রাত ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে অতিবাহিত করে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণÑসমৃদ্ধির জন্য পার্থিবÑঅপার্থিব নেয়ামত হাসিলের লক্ষ্যে ধর্মপ্রাণ ভাইÑবোন আল্লাহ্র দরবারে বিশেষ ফরিয়াদ জানান। বরাত’র কদরের রাত, দু’ ঈদের দু’রাত এবং মাহে রজবের প্রথম রাত। অনন্য সে পাঁচ রাতের প্রথম রাত দিয়ে সূচিত হয় মাহে রজব। চাঁদ উদিত হলেই চান্দ্র মাসের শুরু। রজব’র চাঁদ উদিত হলে প্রিয় নবী পবিত্র দু’হাত তুলে দুআ করতেন, ‘আল্লাহুম্মা বাÑরিক লানা ফী রাজাবা ওয়াশা’বাÑন, ওয়া বাল্লিগনা শাহ্রা রমাদ্বান’। বর্ণনাকারী হযরত আনাস বিন মালিক (রাদ্বি.)। অর্থাৎ হে আল্লাহ্ রজব ও শা’বানে আমাদেরকে বরকত দাও, আর আমাদেরকে মাহে রমাদ্বান তক্ পৌঁছিয়ে দাও’।
এ মাসের ফযীলত অগণিত। এ মাসে মুমিন চিত্তে নেক আমল সম্পাদনের স্পৃহা বর্দ্ধিত হয় বৈকি। হযরত আনাস (রাদ্বি.)র বরাত দিয়ে মুসা ইবনে ইমরান (রাদ্বি.) বলেন, আমি আনাস (রাদ্বি.) কে বলতে শুনেছি, নবী করিম (দ.) ইরশাদ করেন, জান্নাতে একটি বিশেষ ঝর্ণা রয়েছে, যার পানি দুধের চেয়ে শুভ্র, মধুর চেয়ে মিষ্ট। ঝর্ণাটির নাম ‘রজব’। কোন মুমিন নরÑনারী যদি এ রজব মাসে একটি রোযাও রাখে, তবে আল্লাহ্ তাআলা তাঁকে ঝর্ণাটির পানি পান করাবেন। (সূত্র : মাসিক তরজুমান)
বস্তুতঃ মাহে রজব যেন মাহে রমযানের আবহ সূচক। মাহে রজব আল্লাহ্র দুয়ারে উপনীত হবার মাস। মাহে শা’বান পরমদাতা, সর্বাধিপতি আল্লাহ্র নৈকট্যে গমনের জন্য, আর রমাদ্বান তাওবা কবুলকারী মালিক’র সাক্ষাৎ প্রাপ্তির মাস। এ মাসে নেকীর বীজ বপন করা হয়। শা’বান মাসে তাতে পানি সিঞ্চন করা হয় এবং মাহে রমযানে তার ফসল কর্তন করা হয়। কাজেই রজব মাসে অলস, নিষ্ক্রিয় বসে থাকা কেউ সেই ফসলের প্রত্যাশা করা নিষ্ফল। রজব মাসকে বলা হয় শাহরুন আসাম্মু। অর্থাৎ বধির মাস। কারণ, আমল লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতা এ মাসে এত বেশি নেক আমল লিখেন যে, তারা বদ আমল শোনার ফুরসৎও পান না। বধির নামকরণের আরো একটি তাৎপর্য বর্ণিত আছে। তাহলো, রজব মাস অতিবাহিত হবার পর তা আসমানে উত্থিত হয়। আল্লাহ্ তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার বান্দারা তোমাকে কি সম্মান করেছিল? তারা তোমার মর্যাদা রক্ষা করেছিল কিনা। রজব নিরুত্তর থাকে। দ্বিতীয়, তৃতীয় বার প্রশ্ন করলে সে বলে, আমার ¯্রষ্টা হে আল্লাহ্, আপনার নাম সাত্তার (অর্থাৎ গোপনকারী) আপনি আপনার সৃষ্টিকেও নির্দেশ দিয়েছেন, অপরের দোষÑত্রুটি গোপন রাখতে। এছাড়া আপনার হাবীব আমার নাম দিয়েছেন বধির। আমি তাদের নেকী শুনেছি, গুনার আওয়াজ শুনি নি। হযরত সওবান (রাদ্বি.) নবী পাক (দ.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, কোন মুসলমান (পুরুষ কিংবা নারী) যদি রজব মাসের দিনে একটি রোযা রাখে ও একটি রাত (নফল) নামাযে দাঁড়ায়, তাঁর আমলনামায় সারা বছর দিনে রোযা, রাতে নামাযের সওয়াব লিখা হবে। তবে আমলে তাঁর সন্তুষ্টিই উদিষ্ট হওয়া চাই। পাক ভারতের শ্রেষ্ঠ সাধক খাজা গরীব নওয়াযের (রা.) ওরস শরীফও এ চাঁদেরই ৬ তারিখ। এ সমস্ত পুণ্যসমূহ অর্জনের জন্য আল্লাহ্ আমাদের তাওফীক দিন, আমীন।
লেখক : আরবী প্রভাষক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।