জুয়েল আশরাফ :
নীতুর মা মারা গেছে বছর দুই হলো। এরপর বাবাকে বিয়ে করিয়ে ঘরে নতুন মা আসবে, নীতুর খুব শখ। অনেক বলার পরও বাবা বিয়ে করতে রাজি হননি। কারণ, নীতু এখনো ছোটটি। সবে মাত্র স্কুলে পড়ে। স্কুলে ঢুকে তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে-লাফাতে। বাড়িতে এসে স্কুলব্যাগ মেঝেতে ফেলেই গলা ছেড়ে গান ধরে। বাথরুমে পানি ছেড়ে ভাবতে থাকে, এই দুনিয়াতে কত্ত পানি! ফুরায় না কেন? খাবার খেতে বসে উদ্ভট প্রশ্ন, অন্ধকারের রঙ কালো না হয়ে সাদা হলো না কেন? টাক মাথার লোকগুলো চুল না থাকতেও মাথা চুলকায় কেন? গরমে শরীর থেকে ঘাম বের হয়, শীতকালে সরবত বের হতো যদি! নীতুর এসব আচরণ বরদাস্ত করার মতো নয়। নীতুর বাবাই হাঁপিয়ে ওঠেন মেয়েকে নিয়ে। এরপর যদি বিয়ে করে নতুন মা নিয়ে আসেন, তাহলে নীতুকে একেবারেই সহ্য করতে পারবে না। তার চেয়ে মেয়েকে নিয়ে একা আছেন, ভালো আছেন। নতুন মা না আসাতে নীতুর ভারী দুঃখ। কিন্তু দুঃখ ঘুচে গেল ওর সপ্তম জন্মদিনে। জেদ করে বাবাকে বিয়ে করাল। এক শ্রাবণের সন্ধ্যায় বাবা বিয়ে করে নতুন মা নিয়ে এলেন। নীতুর তো আর আনন্দ ধরে না!
পরের মাস নীতুর মহানন্দে কেটে গেল। সেদিন দুপুর থেকেই আকাশে মেঘ জমেছে। মেঘ গুড়ুম-গুড়ুম ডাকছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটাও পড়ছে। এমনিতে নীতুর বৃষ্টিতে ভেজার পাগলামি স্বভাব আছে। কিন্তু তার বাবা বাসায়। নতুন মা রান্নাঘরে। বৃষ্টিতে ভেজা একেবারেই বারণ। গত সপ্তাহে সে দুদিন জ্বরে ভুগেছে। বৃষ্টি দেখলে মনখারাপ হয়। নীতু মনখারাপ নিয়ে গায়ে কাঁথা টেনে শুয়ে পড়ল। অমনি নতুন মা আনন্দিত হয়ে এসে বলল, নীতু! চল মা ছাদে যাই। বৃষ্টিতে ভিজব।
নীতুর আনন্দ আর ধরে রাখে কে! বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে পড়ল। মায়ের সঙ্গে চলে গেল ছাদে। ভিজল। গান করল। আকাশে বাতাসের গান। বৃষ্টিতে ভেজার গান। চিৎকারে ভেসে বেড়ানোর গান। এরপর ছাদ থেকে নেমে নিচে বাগানে এলো। বাগানে ছিল কাদা। নতুন মায়ের সঙ্গে খেলল। কাদামাটি ছোড়াছুড়ির খেলা। দুজন কাদায় একেবারে মাখামাখি হয়ে গেল। নতুন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নীতু হতভম্ব। মা এ রকম খেলবে সে কল্পনাও করেনি।
বিকেলে বাবা-মায়ের সঙ্গে নীতু এলো শপিংমলে। তার জন্য কিছু জামাকাপড় কেনা হলো। একটা দামি পুতুল নীতুর ভারি পছন্দ হয়। কিন্তু এই পুতুল কিনে দেবার কথা বাবাকে সে বলতে পারল না। কারণ পুতুলটা অনেক দামি। সে তাকিয়ে শুধু দেখল পুতুলটাকে। রাতে ঘুমানোর আগে নতুন মা মশারি টানিয়ে দিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল, নীতু মামণি, ঘুমিও না। চোখ খোলা রাখো। আমি এখনই ফিরে আসছি।
এখনই আসার কথা বলে নতুন মা আধঘণ্টা পর এলো। নীতুর চোখ খোলাই ছিল। এবং খোলা চোখে সে এক বিস্ময় দেখতে পেল। শপিংমলের পছন্দের সেই পুতুল! নতুন মা হাতে করে এনে তার সামনে রেখে দিয়ে মিটিমিটি হাসছে। সে অবাক। এতই অবাক যে, মুখ দিয়ে কথা বের করতে পারছিল না। নতুন মা হেসে বলল, মামণি, তুমি খুশি হয়েছ?
নীতু পুতুলটি এক হাতে ধরে, অন্যহাতে নতুন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমার ইচ্ছেগুলো কীভাবে বুঝতে পারো?
নতুন মা আগের মতই হাসিমুখে বলল, তোমার চোখ দেখে সব বুঝে যাই। তোমার চোখ লক্ষ করি। যেসব জিনিসে তোমার প্রবল আগ্রহ, সেসবের দিকে তুমি বারবার তাকাচ্ছ। এভাবে বুঝে যাই তোমার পছন্দ-অপছন্দ।
নীতু বলল, উঁ হুঁ, তুমি জাদু জানো।
নতুন মা শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল, তাই? আমি জাদু জানি?
নীতুও হেসে বলল, হ্যাঁ। তুমি আমার জাদু-মা।
নতুন মা বলল, ‘ঠিক আছে সোনা। এখন জাদু দিয়ে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।’
নীতু বালিশে মাথা রাখল। বুকের কাছে নতুন প্রিয় পুতুল। কপালে চুমু খেল নতুন মা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। নতুন মায়ের ভালোবাসা ও মমতার হাতের স্পর্শে নীতু আরামে ঘুমিয়ে পড়ল।