রহিম উদ্দিন
সকাল বেলায় ঠাকুমার হাঁক ডাকে যে অঞ্জলির ঘুম ভাঙত সে আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে শঙ্খ বাজিয়ে উলু ধ্বনি দিচ্ছে! মেয়েদের এই এক বৈশিষ্ট্য, যে মেয়েটি আজকে প্রেমিকা বিয়ের পর সেও হয়ে যায় একজন নিখুঁত ঘরণী। বিষয়টা প্রথমে অতটা খেয়াল করেনি নিরঞ্জন। নিরঞ্জন একটু ধীর পায়ে হেঁটে পুঁজোর ঘরের দিকে রওনা দিল; সেকি নিরঞ্জন অনেক পিছিয়ে। সবাই বসে পড়েছে একজনের পিছনে অন্যজন! যে নিরঞ্জন কোনদিন পিতাকে ইশ্বরের নাম নিতে শোনেনি সেই রঞ্জন মশায়ও আজ জোড় হাতে ঠাকুরের প্রণাম করছে। এতক্ষণ শুধু নিরঞ্জনই বাকি ছিল। কী সুরেলা কণ্ঠ অঞ্জলির। পিছনে থেকে নিরঞ্জন উঁকি দিয়ে অঞ্জলিকে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কী অমায়িক চেহারা, এমনটা আগে কখনও দেখেনি। নিরঞ্জন কল্পনা করতে পারছে না, একরাতে কিভাবে একজন উড়নচ-ী রমণী একজন পূজারিণী হয়ে যেতে পারে! অবিকল ঘরণী হয়ে সবার মন জয় করেছে গ্রামের অর্ধ শিক্ষিত অঞ্জলি।
নিরঞ্জন সম্পর্কে অঞ্জলির পিসোতু দাদা হয়। অনেক দিনের সম্পর্ক ছিল বলে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের বিয়েটা দিয়েছে অঞ্জলির মা সবিতা রাণী। অঞ্জলির পিতা নেই, এক দাদা আর মা থাকত সাথে ঠাকুরমা। পড়ালেখা করার জন্য নিরঞ্জন কলকাতা থাকত বলেই প্রায় সময় মামা বাড়িতে যেতো; সেই আসা-যাওয়ার মাঝে কখন যে কৃষ্ণকায় অঞ্জলি তার মনের জায়গায় দখল নিয়েছিল তার কিছুই মনে নেই। শুধু এইটুকু জানে ১৫ দিন আগেও তার মা-বাবা কালো পিতৃহীন অল্প শিক্ষিত অঞ্জলির সাথে ইংরেজি শিক্ষিত সরকারি চাকুরে পুত্রের বিয়ে দিতে রাজি ছিলো না। অথচ আজ সকলেই সেই কালো পুজারিণীর পিছনে বসে মা-কালীর নামে উলু ধ্বনি করছে। পৃথিবীটা আজ কেবল অঞ্জলির। মনে হচ্ছে আর অল্পক্ষণ এইভাবে পুজো চললে স্বয়ং দেবতারাও এসে অঞ্জলির পিছে আসন গ্রহণ করবে। নিরঞ্জনের এই ভাবনা শেষ হওয়ার নয় কিন্তু পুজো শেষ হল বলেই তাকে ফিরে আসতে হল বাস্তবতায়। একে একে সবাইকে পুজোর প্রসাদ দিয়ে নমস্কার করে পদ ধুলি নিল অঞ্জলি। এখন সে নিরঞ্জনের সামনে। নিরঞ্জন তাকিয়ে আছে অঞ্জলির কপালের দিকে। অঞ্জলি প্রসাদ তুলে দিয়ে স্বামীকে প্রণাম করল। হিন্দু ধর্ম হোক আর ইসলাম ধর্ম হোক স্ত্রীদের কাছে স্বামী দেবতাতুল্য। এই দিনে এসেও তা আরেকবার প্রমাণ করল অঞ্জলি। ইতোমধ্যে সকলেই প্রসাদ নিয়ে যার যার কাজে চলে গেছে। আশে পাশে এখন আর কেউ নেই। নিরঞ্জন জড়িয়ে ধরল অঞ্জলিকে, যেন দুটো শিমের লতা একে অপরের সাথে প্যাঁচিয়ে আছে। নিরঞ্জন তার অঞ্জলিকে সারা জীবন এমনি করে জড়িয়ে রাখতে চায়।
এক সকালের কথা। তাদের বিয়ের তখনো দুই বছর হয়নি। যথারীতি স্ত্রী অঞ্জলিকে রেখে নিরঞ্জন অফিসে চলে যায়। দুপুরের দিকে নিরঞ্জনের মোবাইলে রিং বেজে ওঠে। মায়ের মোবাইল থেকে ফোন এলে, নিরঞ্জন শত ব্যস্ততার মাঝেও ফোন রিসিভ করতে কালক্ষেপণ করে না। ফোন রিসিভ করতেই তার মা বলল,
– বাবা নিরঞ্জন, তুমি দ্রুত একটু গান্ধীজী হসপিটালে চলে এসে।
– কেন মা
– আমরা বউমা-কে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি।
– ঠিক আছে মা, আসছি।
নিরঞ্জনের মনে খুশির বন্য বয়ে যাছে। কেননা, সে বাবা হতে চলেছে। অনেক দিন ধরে অন্তঃসত্তা বউটার হাসি মুখ দেখেনি। সবসময় এই সন্তানের জন্য আনমনা হয়ে কি যেন ভাবে। আজ বুঝি সন্তান ভূমিষ্ঠ হলেই অঞ্জলির মুখে হাসি ফিরে আসবে। নিরঞ্জন এই মুহূর্র্তে সন্তানের মুখ দেখার আনন্দের চেয়ে স্ত্রী অঞ্জলির হাসি মুখ দেখার আনন্দে বিভোর হয়েছে শতগুণ। খুব দ্রুত সে অফিস থেকে বের হয়ে পড়ে। নিরঞ্জন সরাসরি ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করে রওনা দিল।
প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা পরে নিরঞ্জন হাসপাতালে এসে পৌঁছাল। সবার চোখে জল; কারও মুখে বিন্দুমাত্র কথার লেশ নেই। মনে হচ্ছে এই জগতে মনে হয় হাসপাতালে কোন প্রাণীর শব্দ করা নিষেধ; কথা বলা অন্ন পাপ। পিতার পাশেই বসে পড়ল নিরঞ্জন। হাসপাতালের স্বাভাবিক নিয়মানুরে ডাক্তার নার্স সবাই এদিক ওদিক আসা যাওয়া করছে। তবে নিরঞ্জনের কানে কারও কোন শব্দ আসে না। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রঞ্জন হাতের ইশারা দিয়ে অপরেশন রুমের দিকে দেখিয়ে দিল। নিরঞ্জন হয়তো কিছুটা অনুমান করেছে ঐ রুমে অঞ্জলির অপারেশন হচ্ছে। অনেকক্ষণ পর ডাক্তার বের হলে নিরঞ্জন সবার আগে এগিয়ে যায়। ডাক্তারও নিরঞ্জনের কাঁধে হাত রেখে মাথা নিচু করে পেশাগত উত্তর দিয়ে চলে গেল। ডাক্তার কি বলেছে তা স্পষ্ট বুঝে গেল নিরঞ্জন। মাথায় হাত দিয়ে হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠে নিরঞ্জন। সেই মুহূর্তে নিরঞ্জন একবারও প্রশ্ন করল না তার স্ত্রী কেন হাসপাতালে ভর্তি হল? তার অন্তঃসত্তা স্ত্রীর অনাগত সন্তানের কী হল? এই মুহূর্তে অঞ্জলির মা আর দাদাও চলে এসেছিল। তারাও বুঝতে পারল; অঞ্জলি আর নেই। আর পেটের সন্তান সেতো প্রশ্নই আসে না। কারণ ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা হলে তো আর পেটের সন্তানের পরিপূর্ণতা আসে না। এরপরের দিন থেকে নিরঞ্জন আর একদিনের জন্যও পুজোর ঘরে যায়নি; তার মনে এমন ধারণা জন্ম নিল দেবতা বলতে কিছু নেই। দেব-দেবী সব মানুষের তৈরি একটা মিথ্যা মোহ মায়া। যে অঞ্জলি দেবতাদের এত বেশি পুজো করতো তার যেহেতু এই পৃথিবীতে খুব বেশি দিন বাঁচা সম্ভব হয়নি সুতরাং দেবতাদের পুজো করে আর লাভ কী! অঞ্জলির জন্য প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত নিরঞ্জনের। কিন্তু কিছুদিন যেতেই সে ঠিকই বদলে গেছে। তবে অঞ্জলির প্রতি তার ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়নি, তার যথেষ্ট প্রমাণ রেখে চলেছে সে। প্রতি বছর বিবাহবার্ষিকী পালন অঞ্জলিদের বাসায় আসা যাওয়া সব কিছুই সে পালন করে। দিনে দিনে সবাই অঞ্জলিকে ভুলতে বসেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য অঞ্জলির মা এবং দাদা কিছুই জানত না কেন এবং কিভাবে অঞ্জলি মারা গেল। গোপন রয়ে গেল অঞ্জলির আত্মহত্যার কারণ। এমন কী নিরঞ্জনও না। সবার ধারণা সে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করেছে। কেবল মাত্র নিরঞ্জনের পরিবারের সবাই জানে অঞ্জলি সেদিন নিজের গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যুকে টেনে নিল। তবে ফাস দেওয়ার কারণটা ছিল পুরোপুরি অগোচরে। অঞ্জলি যে সেদিন গলায় ফাঁস দিয়েছিল এই কথাটা দুইটি কারণে নিরঞ্জনের পরিবার নিরঞ্জন এবং অঞ্জলির মা-দাদা থেকে গোপন রেখেছিল। প্রথমত , সবাই মনে করবে অঞ্জলিকে নিরঞ্জনের মা-বাবা জোর করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল, কেননা ;তারা অঞ্জলির সাথে নিরঞ্জনের বিয়ে দিতে রাজি ছিল না। দ্বিতীয়ত, নিরঞ্জন অঞ্জলিকে এত বেশি ভালোবাসত, যদি সে অঞ্জলির ফাঁসির কথা শুনে নিজে কিছু করে বসে সে ভয়ে। বিধির লীলা বোঝা বড়ই মুশকিল। অতঃপর সেই দেবালয়ে আবার পূজারিণী এল।
নিরঞ্জনের ছোট ভাই অধিরঞ্জনের বউ সুপর্ণা এই বাড়ির বড় বউয়ের বিষয়ে সবই জানে, তাই শশুরালয়ে এসেই প্রথম দিন পুজোর ঘর পরিষ্কারে নেমে পড়ে। কালী দেবীর ঠিক পায়ের পিছনেই চোখে পড়ে একটা ডায়েরি। এই ঘরটা যেমন অনেক দিন ব্যবহার হয়নি তেমনি ডায়েরিটাও অনেক দিন আগে থেকে পড়ে আছে বুঝতে অসুবিধা হল না সূপর্ণার। বেশ আগ্রহ নিয়ে সে ডায়েরিটা পড়া শুরু করল। সেখানে একটা চিরকুটও লেখা আছে। যে চিরকুটে লিখা ছিল,’ তোমার সকল পাপ আজ আমি নিজ হাতে দেবী কালীর পায়ের নিচে দিলাম। তুমি এখন পাপ মুক্ত, দেবতুল্য মানব শিশু! তুমি যেন নীলা মিত্রকে নিয়ে সুখী হতে পারো, সেই রাস্তাই আমি তৈরি করে দিলাম। তোমার যে পাপ কেউ জানে না তা আমিও কাউকে জানবো না; যদি না মা কালী নিজে জানায়। তোমাকে বড়ই বিশ্বাস করিতাম, ভালোবাসিতাম! তুমিও আমাকে তার উপযুক্ত মূল্য দিয়েছ, নিরঞ্জন। আমাকে ক্ষমা কর।’
একে একে ডায়েরিটা সুপর্ণা ,অধিরঞ্জন, রঞ্জন সবাই পড়ল। ডায়েরিটা ছিল নিরঞ্জনের নিজের হাতের লেখা। নিরঞ্জনের কলকাতা জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত! নিরঞ্জন বিশ্ববিদ্যালয়ে নীলা নামে এক মেয়েকে ভালোবাসত এবং তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও বিদ্যমান ছিল। কিন্তু একইসাথে অঞ্জলিদের বাড়িতে আসা যাওয়া করতে করতে নিরঞ্জন, কালো অঞ্জলির জন্যও একটা দায়বদ্ধতা আবিষ্কার করল। যার ফলশ্রুতিতে কালো অঞ্জলিকে পরিবারের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ে করে দায়বোধ হতে মুক্তি লাভ করতে চেয়েছিলো। পক্ষান্তরে সতীত্ব হারানো নীলা এখনও পর্যন্ত নিরঞ্জনের জন্য বিয়ের পিঁড়িতে বসেনি। এমনও নয় যে, নিরঞ্জন নীলাকে ভুলে গেছে। প্রতিনিয়ত সে নীলাকে স্মরণ করে এই ডায়েরিটা লিখত। নীলাকে ঠকানো ও বিয়ে করতে না পারার হতশা ও মায়াজালে বন্দি সে; অন্যদিকে অবিকল কিছু নিখুঁত ভালোবাসা অঞ্জলির জন্য। বিষয়গুলো কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিল না অঞ্জলি। তাই এই সব লেখা পড়ে অঞ্জলি সেদিন গলায় দড়ি দিয়েছিল তা এখন সবার কাছে স্পষ্ট। সবার আপত্তি সত্তেও যে নিরঞ্জন, অঞ্জলিকে বিয়ে করেছে; কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে সে নীলাকে পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু সেই বিচ্ছেদেরই গোপন কীটেরা প্রতিনিয়ত তাকে গোপনে কুঁড়ে খাচ্ছে। অন্যদিকে অঞ্জলিকে বিয়ে না করলেও কালো মেয়েটির উপর মহা অন্যায় ও দায়বদ্ধতা থেকে যায়। তাই সব কিছুর বিপরীতে গিয়ে সে অঞ্জলিকে বিয়ে করেছে। বিপরীতে নীলার জন্য, একটা ডায়েরি ভরা অনুতাপ।
এখন অঞ্জলির অপমৃত্যুর চেয়ে সবার কাছে নিরঞ্জনের অন্তর্দহন ও মানবিকতা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। একদিন সবাই মিলে নিরঞ্জনের বিছানায় ডায়েরিটা যতœকরে রেখে আসে। নিরঞ্জন অফিস থেকে ফিরে ডায়েরিটা হাতে নিয়ে চিরকুটটা পড়েছে। সেই এখন বুঝতে পারল; অঞ্জলি সেদিন আত্মহত্যা করেছে। তার চোখ দিয়ে কান্নার ধারা ছুটেছে। আজ অনেক দিন পর নিরঞ্জন আবার দেবী কালীর পুজো ঘরে প্রবেশ করে। মাথাটা নুয়ে দিল মা কালীর পায়ে। সেই যে ছিল শেষ বার প্রণাম। নিরঞ্জন আর মাথা তুলে ফিরে আসেনি; কালীর লীলা খেলায় বলিদান হয়েছে একটা নিরেট প্রেমিক ও দায়বদ্ধ হৃদয়ের ।