রাজিব শর্মা »
নিত্যপণ্যের দামের নাগাল যেন টানা যাচ্ছে না। বাড়তি দামে নাভিশ্বাস উঠছে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোক্তাদের। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলো জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর জেলা প্রশাসন ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীরা একাধিকবার আশ্বাস দিয়েছিলেন, রমজান ঘিরে নিত্যপণ্যের দাম তারা বাড়াবে না। ব্যবসায়ীদের সেই আশ্বাস শুধু কথাতেই সীমাবদ্ধ। কাজে কিংবা বাস্তবে তা মিলছে না।
রমজান শুরু হওয়ার ১০ দিন আগে থেকেই আটা, ময়দা, খেজুর, শুকনা মরিছ, মুরগী, মাছসহ আরেক দফা বেড়েছে বেশ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম। তবে ইফতারিতে ব্যবহৃত পণ্যের দাম বেড়েছে বেশি। এ ছাড়া মাছ, মাংস, ডিম ও সবজির মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। রমজানে ইফতারি তৈরিতে সাধারণত ছোলা, অ্যাঙ্কর ডাল ও বেসন বেশি ব্যবহার হয়। রোজার ১০ দিন আগে থেকেই ছোলার দাম কয়েক টাকা কমলেও অন্য সকল নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়তি।
গতকাল বৃহস্পতিবার নগরীর খাতুনগঞ্জে ও রেয়াজউদ্দিন বাজার সরেজমিনে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা ছোলার দাম কয়েক টাকা কম দামে বিক্রি করলেও অনান্য নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বাজারে পর্যাপ্ত যোগান থাকা স্বত্বেও অ্যাংকর ডাল এক বছরে কেজিতে দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। কেজিতে তা গতকাল বিক্রি হয়েছে ৬৮ থেকে ৭৫ টাকা।
খাতুনগঞ্জের ডাল বিক্রেতা রহমান ট্রেডিংয়ের ম্যানেজার আবদুর রহমান বলেন, আমরা যে অ্যাংকর ডাল বিক্রি করছি তা আমাদের আগের আমদানি করা। নতুন এলসি করা মাল এখনো বাজারে আসেনি। বাজারে আসলে দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অনান্য ডালে কয়েক টাকা কমেছে।
তাছাড়া রমজান উপলক্ষে বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ খেজুর মজুদ করা হয়েছে। কিন্তু গত বছরের তুলনায় এবছর খেজুরের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ।
খাতুনগঞ্জের খেজুর আড়তদার এসবি ট্রেডিং এর স্বত্ত্বাধিকারী আবু ছালেক বলেন, ডলার সংকটের কারণে এবছর অনেক দেরীতে এলসি খুলতে হয়েছে। তাছাড়া অনান্যবারের তুলনায় এবার এলসি করতে হয়েছে বেশি ডলারের রেটে। বাজারে এখনো এলসি করা প্রায় খেজুর আসেনি। খেজুর আসতে সময় লাগবে আরো ১৫ থেকে ২০ দিন। দেশে বছরে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ খেজুর না থাকাতেই একটু বাড়তি বিক্রি করতে হচ্ছে। আমদানি করা খেজুর বাজারে আসলে দাম কমে যাবে।
অন্যদিকে গত ছয় মাসের ব্যবধানে চারবার চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে। এরপর রমজানে যেন চিনির দাম না বাড়ে এবং ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে সেজন্য সরকার ৫ শতাংশ কর কমিয়েছে। এতে দাম কমার কথা থাকলেও বাজারের চিত্র একেবারে ভিন্ন।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায়, চিনি বিক্রি হচ্ছে ১০৮ থেকে ১০৯ টাকা দরে যা এক সপ্তাহ আগে ১০৬ থেকে ১০৭ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল। আর খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১১৫ থেকে ১২০ এবং প্যাকেটজাত চিনি ১১২ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া লাল চিনি (দেশি) বিক্রি হয়েছে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা দামে। সরকারি হিসাবে গত এক বছরে চিনির দাম প্রায় ৪৮ শতাংশ উপরে বেড়েছে।
এদিকে মাছ-মাংস এখন অনেকটাই স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মধ্যবিত্তরাও মাছ-মাংস কিনতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ছেন। মুরগির বাজার দেড় মাস ধরেই অস্থির। দফায় দফায় বেড়ে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হয়েছে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা এবং সোনালি জাতের মুরগি ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের বাজার ডজনে ৫টাকা কমে ১২৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। রমজানের আগে থেকেই সকল ধরনের মাছের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। গতকাল বকশির হাট বাজারে তেলাপিয়া ও পাঙাশ বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। মানভেদে রুই-কাতলার কেজি বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। চিংড়ি আর ইলিশ কেনা এখন বিলাসিতা। আকারভেদে চিংড়ি ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা এবং ইলিশ ৭০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
সবজির বাজারে দেখা যায়, লেবুর বাজার চড়া। দাম বেড়ে হালিপ্রতি লেবু আকারভেদে বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। তবে বড় বাজারগুলোতে কিছুটা কম দামে মিলছে লেবু।
বছরের অন্য সময়ের চেয়ে রমজানে বেগুনের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এ জন্য রমজানের আগেই আগুন লেগেছে বেগুনে। গোল বেগুনের কেজি বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে। তবে লম্বা বেগুন কিছুটা কমে ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে শসার টান তেমন নেই। তবু দাম তুলনামূলক বেশি। মানভেদে ৫০ থেকে ৭০ টাকা দরে শসা বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচের দামও কিছুটা চড়া। মাঝে কয়দিন কমে আবার বেড়েছে দাম। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে।
রেয়াজউদ্দিন বাজারে রমজানের বাজার করতে আসা রফিকুল আলম নামের এক ক্রেতা বলেন, আমরা প্রতিবছরই দেখি ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কোন বছরই নিত্যপণ্যের দাম কমেনি। দুয়েকটি পণ্যের দাম কমিয়ে এটি সমালোচনাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা ব্যবসায়ীদের। সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি।
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ব্যবসায়ীরা আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তারা মূল্য তালিকা, ক্রয়-বিক্রয় বিল ভাউচার রাখবে কিন্তু তারা তা রাখছে না। তারা যদি তাতের স্বচ্ছতার জায়গা থেকে নিজেদের সংশোধন না করে তাহলে তো আইন প্রয়োগ করে সবকিছু হয় না। অধিদফতরের আইন অনুযায়ী বাজারে তদারকি চলছে। রমজানে আরো জোরদার করা হবে।
জেলা প্রশাসনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন ব্যবসায়ীদের বিষয়টি বুঝতে হবে। আমরা বলছি না তাদের লোকসান দিয়ে নিত্যপণ্য বিক্রয় করতে। তারা নিত্যপণ্য সঠিক দামে বিক্রয় করুক।
রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াবে না বলে প্রশাসনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ব্যবসায়ীরা রাখছে না ভোক্তা অধিকারের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যবসায়ীরা তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেষ্টা করছে। আমরা চাই যে কোন অবস্থায় যেন নিত্যপণ্যের দাম না বাড়ে। যদি সরকারের নির্ধারিত মূল্যের বাইরে কোন ব্যবসায়ী চড়া দামে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায়, সরকারি বিধিমালা লঙ্গন করে তাহলে প্রশাসন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।