নিজস্ব প্রতিনিধি, টেকনাফ :
দেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত প্রবাল দ্বীপটি ‘নারকেল জিঞ্জিরা’ নামে খ্যাত কক্সবাজার টেকনাফের সেন্টমার্টিন। প্রতিবছর এই দ্বীপে দেশ-বিদেশে থেকে হাজার হাজার পর্যটক আসেন। পর্যটন মৌসুমে প্রায় প্রতিনিদিই শত শত মানুষ যায় এ দ্বীপে। পর্যটনের জন্য অপার সম্ভাবনার এ দ্বীপে পর্যটকদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা থাকলেও এখানকার স্থানীয় জনসাধারণ নানান সংকটে জর্জরিত।
অভিযোগ রয়েছে, জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় ‘পেটোয়া’ শ্রেণির লোকজনের দৌরাত্ম্য ও দ্বীপবাসীর জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। দিনে দিনে এর চিত্র আরও ভয়াবহ হচ্ছে। মানবসৃষ্ট সমস্যা ছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
জানা গেছে, সেন্টমার্টিনবাসী অন্যতম প্রধান সমস্যা যোগাযোগ। টেকনাফের মূল ভূখণ্ড থেকে জাহাজে চড়ে দ্বীপে যেতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। আর কাঠের নৌকা হলে সেই সময় চার ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। ফলে যে কোনও জরুরি কাজে টেকনাফ ও জেলা সদর কক্সবাজার আসা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না।
স্পিড বোট থাকলেও শুষ্ক মৌসুম ছাড়া তা চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সমস্যা হলো মোটা অংকের জাহাজ ভাড়া। তার সঙ্গে রয়েছে ঘাটে ব্যাপক হারের চাঁদাবাজি।
দ্বীপে একটি মাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। তাতে একজন এমবিবিএস চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সেখানে পা পড়েনি কোনও চিকিৎসকের। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে ‘ছাগলের খোয়াড়’ বলেন দ্বীপবাসীরা।
সেন্টমার্টিন পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় হলেও এখনও পর্যন্ত দ্বীপে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকলেও তা শুধুই পর্যটকদের জন্য। সৌর বিদ্যুতের দেখা মিললেও দরিদ্রতার কারণে অধিকাংশ মানুষ এর বাইরে। দ্বীপে এক সময় সরকারি উদ্যোগে একটি অস্থায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থাকলেও ১৮ বছর ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে।
৯ হাজার মানুষের এই দ্বীপে রয়েছে একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাতেও রয়েছে শিক্ষক সংকট। এই বিদ্যালয়ে ৫০২ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন মাত্র দু’জন শিক্ষক।
সেন্টমার্টিনে রড, সিমেন্টসহ আধুনিক নির্মাণ সামগ্রী নেওয়ার অনুমতি নেই। এতে করে অনেকে স্থাপনা নির্মাণ করা যাচ্ছে না। তবে প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে এ নিয়মের বাধা নেই। সাধারণ লোকজন না পারলেও প্রভাবশালীরা ঠিকই রড-সিমেন্টের বাড়ি করছেন। একইভাবে বহুতল ভবনের নির্মাণের নিয়ম না থাকলেও প্রভাবশালীরা বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। স্থানীয়দের বাধা দিলেও প্রভাবশালীদের বাধা দেয় না পরিবেশ অধিদফতর-এমন অভিযোগ করেছেন দ্বীপবাসী।
ব্যাংকিং সুবিধার হয়তো দ্বীপের অনেকের কাছে অজানা। সেন্টমার্টিনে কোনও ব্যাংকের শাখা নেই। এ কারণে অনেকে চাইলেও ব্যবসা করতে পারছেন না।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিরাপত্তা নিয়ে সদা সংকিত দ্বীপবাসী। সাগরে পানি বাড়লেই তা ধেয়ে আসে লোকালয়ে। শুষ্ক মৌসুম ছাড়া বছরের পুরো সময় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্কে থাকে দ্বীপের লোকজন। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে দ্বীপটি ক্রমান্বয়ে ভেঙে যাচ্ছে। তা রোধে এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা হয়নি।
দ্বীপবাসীর সমস্যার আরেক নাম তাদের সেবায় নিয়োজিত কোস্টগার্ডও। কোস্টগার্ড তল্লাশির নামে করে হয়রানি। সেই সঙ্গে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। একইভাবে জেলেদেরকেও হয়রানি করছে তারা।
সেন্টমার্টিন আদর্শ সংসদের সভাপতি হেলাল উদ্দীন সাগর বলেন, সেন্টমার্টিন আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন স্পট। কিন্তু সেন্টমার্টিন নিয়ে সরকারের সে রকম কোনও পরিকল্পনা নেই। অথচ অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল।’
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, আমি সরকার দলীয় হলেও স্বীকার করতেই হচ্ছে দ্বীপবাসীর জীবনমান উন্নয়নের তেমন কিছু করা হয়নি।’
এ ব্যাপার টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপের অনেক সমস্যা আছে। ঘাটে হয়রানি, নৌযান সমস্যা, দ্বীপের নিরাপত্তা। কিন্তু পরিবেশ সংকটাপন্ন হবে বিধায় অনেক কিছু করার থাকলেও করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন মহলকে জানাবো।’
টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে অনেক সমস্যা রয়েছে তা জানি। চেষ্টা করছি সেসব সমস্যাগুলো নিরসন করতে। পর্যায়ক্রমে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।’