তাহমিনা আলম »
শুরুতেই স্বীকার করছি, আমি সাহিত্যবোদ্ধা নই। আর সাহিত্যের সমালোচক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা একেবারে শূন্যের কোঠায়। তারপরও সাধারণ পাঠক হিসেবে নেহাত আনন্দলাভের বাইরেও কিছুকথা ও চিন্তা মনে ঘুরপাক খায়। সেসব চিন্তার কথার প্রকাশ করার জন্যই আজ এই ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
বাংলাদেশের সাধারণ পাঠকদের কাছে মহি মুহাম্মদ (১৯৭৪) নামটি খুব বেশি পরিচিত নয় হয়তো। তবুও তিনি সমসাময়িক কালের কয়েকজন প্রতিশ্রুতিশীল কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম।
লেখালিখির হাতেখড়ি তরুণ বয়স থেকেই। লিখেছেন গল্প ও উপন্যাস। ‘অহল্যাকথা’, ‘সুচেতনা ও হরিশ্চন্দ্রলাইন’, ‘কয়েকজন শেফালির গল্প’ ইত্যাদি গল্পগ্রন্থের পাশাপাশি লিখেছেন উপন্যাস ‘আড়াইপাতা’ ‘ঘাইহরিণী’, ‘মেনকা’ ‘কফিনের উইলি’, ‘উড়নচণ্ডী’ ও ‘ভাড়াবউ’ ও ‘অনিন্দিতার একদিন’-এর মতো ভিন্নধর্মী ও রোমাঞ্চকর উপন্যাস। তাঁর এসব লেখায় উঠে এসেছে সমাজের প্রান্তিক মানুষের জীবনযাপনের করুণ কাহিনি। দলিত-নিষ্পেষিত, অস্পৃশ্য এসব মানুষের নিত্যদিনের দুঃখ-কষ্ট, শোষণ-বঞ্চনা, তাদের কাম ও কামনা, স্বার্থ ও সংকীর্ণতা, অশিক্ষা ও কুসংস্কার তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য। তাঁর সাহিত্যের চরিত্ররা এসেছে সমাজের অবহেলিত শ্রেণি থেকে। যেমন ‘আড়াইপাতা’ উপন্যাসটি চা-শ্রমিকদের করুণ জীবনযাপনের এক নিমর্ম আলেখ্য ‘মেনকা’য় আছে এক অসহায় নিপীড়িত নারীর করুণ আর্তনাদ।
একইভাবে অহল্যাকথা, সুচেতনা ও হরিশ্চন্দ্রলাইন, কয়েকজন শেফালির গল্প ইত্যাদি লেখায় অনুপুঙ্খ বর্ণনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে নিষ্পেষিত ও শোষিত শ্রেণির নর-নারীরা। তাছাড়াও ‘ময়নাদ্বীপের’ (২০১৪) মতো বহুলপঠিত উপন্যাস তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে স্থান দিয়েছে।
সম্প্রতি লেখকের যে উপন্যাসটি পড়ে নতুনত্বের স্বাদ পেলাম তা হলো নয়নপোড়া (২০২১)। অন্যান্য সৃষ্টিকর্মের সাথে তুলনা করলে ‘নয়নপোড়া’ একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকের ও ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস। অন্যান্য গল্প-উপন্যাসের মতো ভাগ্য বিড়ম্বিত, হতদরিদ্র, প্রান্তিক শ্রেণির জীবনসংগ্রামের কথকতা এখানে নেই। গতানুগতিক ও অতি পরিচিত কাহিনির পরিবর্তে লেখক ‘নয়নপোড়া’ উপন্যাসে নিয়ে এসেছেন এক ভিন্নধর্মী সুর। রহস্য, রোমাঞ্চ, সুফিতত্ত্ব তথা আধ্যাত্মবাদের বাতাবরণে লিখিত এ উপন্যাসটি। উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয় কুতুব নামের একজন তরুণ সাংবাদিককে ঘিরে। সুতরাং উপন্যাসটির কেন্দ্রিয় চরিত্র কুতুব। শুরুতে কুতুবের পরিচিতি পর্বের পরপরই শুরু হয় উপন্যাসের রহস্যময়তা। এক সকালে চিফ এডিটরের ফোন পেয়ে অতিব্যস্ত হয়ে সে রওনা দেয় নয়নপোড়া গ্রামের দিকে। চিফের নির্দেশ নয়নপোড়া গ্রামের ফজর আলী সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা। মূলত সেই উদ্দেশ্যে কাকডাকা ভোরে শত বিড়ম্বনা সহ্য করে এক বাইক আরোহীর পেছনে সে নয়ন পোড়ার উদ্দেশে পা বাড়ায়। ‘নয়নপোড়া’ নামের পেছনেও রয়েছে এক মর্মান্তিক ও রহস্যময় ইতিহাস। যা পাঠক উপন্যাসের শেষে জানতে পারছে। কুতুবের নয়নপোড়া গ্রামে যাত্রার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি প্রবাহ এগিয়ে যায়। যাত্রাপথে আদিবাসী মেয়ে দিয়ানার সাথে আলাপের সুখকর স্মৃতি, বৃষ্টির বিড়ম্বনা, অচেনা জায়াগায় রাত কাটানোর অনিশ্চয়তা, মোবাইলে চার্জ শেষ হয়ে যোগাযোগহীন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার অসহায়ত্বের মধ্যে সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে কে যেন তাকে বলে উঠল ‘কই যাইবেন? নয়নপোড়া? এত রাইতে নয়নপোড়া যাইবেন কেন?’ সেই ভয়ানক অন্ধকার রাতে আলোকবর্তিকা হয়ে যে লোকটি তাঁর কাছে এগিয়ে এলো তিনিই ছিলেন সেই রহস্য মানব ফজল আলী। যার সন্ধানে কুতুবের এখানে আসা। ফজর আলীকে অনুসরণ করে ‘নয়নপোড়া’ গ্রামের উদ্দেশে পথ চলতে থাকে তরুন সাংবাদিক কুতুব। চলতে চলতে কুতুবের সাথে ফজর আলীর কথোপকথনে কুতুব আবিষ্কার করে ফজর আলীর জীবনের লুকায়িত কষ্ট। অজানা কাহিনি ও আধ্যাত্মিকতা।
যেতে যেতে ফজর আলীর সাথে কুতুব পৌঁছে যায় সুফি কামেল গোলাম সারওয়ার মুরাদ সীতাকুণ্ডীর আস্তানায়। এ পর্যায় পাঠক জানতে পারবে গোলাম সারওয়ার মুরাদুল ইসলামের সুফিসাধক হয়ে ওঠার কাহিনি। এক্ষেত্রে নয়নপোড়া উপন্যাসের সঙ্গে রবিশংকর বলের ‘আয়নাজীবন’ উপন্যাসের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। কারণ পর্যটক ইবনে বতুতার কথনে বর্ণিত ‘আয়নাজীবন’-এর কেন্দ্রে আছে মওলানা রুমির জীবন। ইসলামী ধর্মবেত্তা ও পণ্ডিত জালালুদ্দীন বলখি থেকে মাওলানা রুমি হয়ে ওঠার আখ্যান এই আয়নাজীবন উপন্যাসটি। আয়নাজীবন এর কাহিনি কথনে অদ্ভুত এক মায়াজাল তৈরি করেছেন লেখক। সেই মায়ায় হারিয়ে যেতে হয় পাঠককেও। যেমন নয়নপোড়া উপন্যাসে কুতুবের বর্ণনায় ও পাঠক নিজেকে খুঁড়তে খুঁড়তে নিজের স্মৃতিতে নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে নিজের মধ্যে লীন হয়ে যায়। অজস্র কাহিনির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় ‘আয়নাজীবন’। যেন লতা-পাতা, ফুল-সমেত একটি বাগান। নয়নপোড়ার কাহিনিও ঠিক তেমনই। কুতুব ও ফজর আলী মুরাদের খোশগুলবাগে গিয়ে দেখে লাল গালিচা আচ্ছাদিত ও মোম জোছনা পরিবেষ্টিত এক রহস্যাবৃত জলসাঘর। জলসাঘরে নাহিয়ান নামে এক যুবকের কাওয়ালী গানের সুর মূর্ছনায় বুঁদ হয়ে যায় কুতুব। মুহূর্তেই কুতুব ভুলে যায় কে সে? কোথা থেকে এসেছে, উদ্দেশ্যই বা কী? সে যেন যুগ যুগ ধরে এখানেই বসে আছে। সুফি সাধকরা যেমন ভয়ে নয় প্রেমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। আল্লাহর প্রেমে জাগতিক সব কিছু ত্যাগ করে কুতুবের অবস্থা ও তেমনি। একের পর এক গজল আর শায়েরের সূরমূর্ছনায় সে যেন জাগতিক সব কিছু ভুলে গিয়েছে।
মুরাদ সাহেব আর ফজর আলীর কথাবার্তা যখন তুঙ্গে, তখন কুতুব কোথায় যেন জিকিরের সুরেলা ধ্বনি শুনতে পায়। তার মনকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে এ ধ্বনি। কিন্তু‘ কোন কক্ষে এই জিকিরজলসা বসেছে সে বুঝতে পারছে না। কেবল হারমনিয়ামের তীক্ষ্ম মিউজিক তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানছে। সুফিগায়করা যেমন আকাশ ও মাটির পরিসরে চক্রাকারে ঘূর্ণিনৃত্যে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন, জিকিরের এই বর্ণনা ভঙ্গির মধ্যেও এসেছে সেই মেজাজ।
মুরাদ সাহেব ও সাবিনা বিনতে ওয়াজেদের গড়া খোশগুলবাগ যেন কুতুবকে মোহাবিষ্ট করে রাখে। সে জাগতিক ও পার্থিব সব কিছু ভুলে যায়। নয়নপোড়ার যাত্রী কুতুব তার গন্তব্য ভুলে ডুবে যায় সুরের গহিনপুরে। কুতুবের মন এক জটিল ভাবনার ভিতর ডুবে যেতে চায়। সে ভাবে যদি শহরে ফিরে না গিয়ে খোশগুলবাগে থেকে যেতে পারত, তাহলে কী এমন ক্ষতি হবে? কে তাকে খুঁজবে? কুতুবের এমন ভাবমত্ততার মধ্য দিয়েই নয়নপোড়া উপন্যাসের সুফিতাত্ত্বিক তথা আধ্যাত্মিক জীবনদর্শন সহজেই ফুটে ওঠে।
কুতুবের এরূপ আধ্যাত্মিক ভাবমত্ততার হাত ধরে এ উপন্যাসে আসে পদ্মাবতী ও বৈষ্ণব পদাবলীর প্রসঙ্গ আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যে পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনা এবং বিদ্যাপতির বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধার রূপ বর্ণনার অভিনবত্ব নয়নপোড়া উপন্যাসকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়। লেখকের বর্ণনায় আলাওলের পদ্মাবতীর চোখ খঞ্জনা পাখির চোখকেও হার মানায়, যা দেখে হরিণেরা বনে লুকিয়ে পড়ে। তার পা পর্যন্ত লম্বা চুলে মৃগনাভির সৌরভ। বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধা বাইরে এলে হঠাৎ যেনো মেঘের কোলে বিদ্যুৎ চমকে যায়। অল্পবয়সী রাধাকে ফুলের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
খোশগুলবাগে মোহাবিষ্ট থাকার পর এক সময় কুতুবের বের হওয়ার সময় আসে। খোশগুলবাগের আলোর রোশনাই আর গজল শায়েরের মায়াজাল ছিন্ন করে বের হওয়ার সময় কুতুব উপলব্ধি করে যে, এখানে অত্যন্ত সুচারুভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে মাওলানা জালালুদ্দীন রুমির জীবন। জালালুদ্দীন রুমি ছিলেন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী মনীষী। তিনি ছিলেন একাধারে সুফিতত্ত্ববিদ, মৌলবিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা। সর্বোপরি একজন সাধক পুরুষ। সুফিদর্শনের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি ব্যাপক আলোচনা করেছেন। তিনি যে মরমী দর্শনের বাণী কাব্যিক ছন্দে প্রকাশ করেছেন তার মধ্যে প্রেমতত্ত্ব অন্যতম। জালালুদ্দীন রুমি তার বিখ্যাত ‘মসনবী’ কাব্যের লেখনীতে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক প্রেমের রূপরেখা প্রনয়ণ করেন মসনবী কাব্যের বিভিন্ন কবিতার লাইন আমরা ‘নয়নপোড়া’ উপন্যাসে মুরাদের কন্ঠে শুনতে পাই। ফলে নয়নপোড়া উপন্যাস পাঠে পাঠক সহজে সুফিদর্শন ও আধ্যাত্মিক প্রেমের স্বরূপ ও উদ্দেশ্য সহজেই বুঝতে পারবে।
অবশেষে খোশগুলবাগকে বিদায় জানিয়ে কুতুব আবার রওনা হয় নয়নপোড়ার পথে। কিন্তু শেষ হয় না সেই রহস্যময় পথ। ফজর আলীর শায়েরি শুনতে শুনতে কুতুব এক ঘোরের মধ্যে হারিয়ে যায়। এই ঘোরের মধ্যে জীবন জগতের সবকিছু যেন পানসে মনে হয়। লেখক এই পর্যায়ে নয়নপোড়া গ্রামের নামকরণ নিয়ে ফজর আলীর কথনে এক লোমহর্ষক কাহিনি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন। যদিও নয়নপোড়া উপন্যাসের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সুফিতত্ত্ব এবং আধ্যাত্মবাদ তবুও এ উপন্যাসে মানবীয় প্রেমানুভূতির বিষয়গুলো একেবারে উপেক্ষিত থাকেনি। কারণ নয়নপোড়া গ্রামের নামকরণের পেছনেও রয়েছে দুজন মানবমানবীর মর্মান্তিক প্রণয়গাঁথা। তাছাড়া রয়েছে উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র কুতুবের সাথে তামারার প্রেমঘটিত সম্পর্কের অম্ল-মধুর রসায়ণ। যেখানে বিরহী তামারা দিনের পর দিন কুতুবের মেসেজের প্রতীক্ষায় দিন গুনে।
অবশেষে নয়নপোড়া গ্রামে পৌঁছানো নিয়ে পুনরায় রহস্যের জাল বিস্তৃত হতে থাকে। এসব কাহিনির পর যে বিষয়টি পাঠককে অবাক করে দেবে Ñ তা হলো যার ফোন পেয়ে কুতুব নয়নপোড়া নামক রহস্যকে আবিষ্কার করতে গিয়েছিল, সে আসলে কুতুবকে ফোন করেনি। তাহলে কে ফোন করেছিল কুতুবকে? কোন ঐশ্বরিক শক্তি, কোন অদৃশ্য মায়াজাল? কুতুবকে রহস্যাবৃত খোশগুলবাগের গোলাকধাধাঁয় নিয়ে গেল কে?
অবশেষে কুতুব ফিরে এলো চিরচেনা শহরে। নাগরিক জীবনের কোলাহল তাকে নিক্ষেপ করলো নিঃসীম শূন্যতায়। সেই শূন্যতায় খান খান হয়ে গেল তার হৃদয়। তারপরও তো তাকে বেঁচে থাকতে হবে। সাধকদের যাত্রাপথ তো ছায়াময়। কখনো তা অবিশ্বাস্য ঘটনায় ভরপুর। নয়নপোড়া উপন্যাসে লেখক কুতুবকে সেই রহস্যময় সাধক পুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছেন।
সুফিদর্শন তথা আধ্যঅত্মিকবাদকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসে বৃত্তাকারে ঘুরেছে বিভিন্ন গল্প, সুফি অনুষদ। আছে অজস্র উপকাহিনি কিন্তু সেগুলো মূল কাহিনির সাথে প্রকটভাবে যুক্ত নয়। লেখকের দীর্ঘদিনের সাহিত্য সাধনাকে, এবং পাঠকের সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয় ‘নয়নপোড়া’ উপন্যাসটি। একটু সচেতন থাকলে দেখা যাবে একই প্রবাহ মানবতার মধ্যেও স্বরের ভিন্নতা ও বোধের ভিন্নতা কত তীব্র। উপন্যাসটির বিশেষত্ব এখানেই। কাহিনি, চরিত্র, আঙ্গিক শব্দচয়ন বর্ণনাভঙ্গি সবদিক থেকে বিচার করলে ‘নয়নপোড়া’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রম সৃষ্টি Ñ একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।