হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
মহান আল্লাহ্ তাআলার জন্য সমস্ত প্রশংসা, যিনি আমাদেরকে সঠিক পথের দিশা দানের লক্ষ্যে আমাদের প্রিয় নবীকে প্রেরণ করেছেন। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করি, যিনি আমাদের অন্তরে বাইরে পবিত্রতার জন্য ঈমান-আকীদা ও হালাল-হারাম’র বাধ্যতা আরোপ করেছেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা, যিনি আমাদের প্রতি একান্ত দয়া পরবশ হয়ে তাঁর হাবীব (দ.)র খাতিরে বছরের বিশেষ কিছু রাত দান করেছেন। তন্মধ্যে মধ্য শা’বানের মহান রাত, যাতে বনু কাল্ব গোত্রের ছাগপালের লোমেরও অধিক সংখ্যক উম্মতে মুহাম্মদীকে আখিরাতের শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেন।
আল্লাহ্ একমাত্র উপাস্য। তাঁর কোন শরীক নাই। হায়াতÑমাওত, রিযকÑইয্যতÑসবই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। তাঁর প্রভুত্বে কারো কোন অংশীদারিত্ব নাই। আমাদের সঠিক পথের নির্দেশক, হাশরে সুপারিশকারী, নাজাত ও মুক্তির কা-ারী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বন্দেগীর মূর্তরূপ, তাঁরই পবিত্র বাণীবাহক, তাঁর বান্দা ও রাসূল।
আল্লাহ্র রাসূলের আহ্বানে সর্বাগ্রে সাড়া দিয়ে যাঁরা ঈমানের নেয়ামতে ধন্য হয়েছেন, তাঁরা হলেন তাঁর সাহাবায়ে কেরাম। উম্মতের মধ্যে তাঁরা শীর্ষস্থানীয়। পরে যাঁরা এসেছেন তাঁদের কেউ সাহাবার সমকক্ষ হতে পারেন না। কেননা তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে রাসূলুল্লাহ্র তত্ত্বাবধানে ঈমানÑআমলের প্রশিক্ষণ লাভ করেন। তাঁদের জন্য আল্লাহ্র সন্তুষ্টির ঘোষণা রয়েছে পবিত্র কুরআনে। তাঁর ঘোষণা, ‘রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম, ওয়া রাদ্বূ আনহু’Ñ অর্থাৎ আল্লাহ্ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট, আর তাঁরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। বস্তুতঃ এর ওপর আর সাফল্য নেই। সাহাবা হওযার জন্য নবীজিকে ঈমানসহকারে দেখা শর্ত। ঈমান ব্যতীত কোন আমল, ফযীলত স্বীকৃত নয়। আমল, যা বান্দার মর্যাদা বাড়ায়, অবশ্যই তা ঈমান ছাড়া ধর্তব্য নয়। ঈমানদার’র আমলই সোনায় সোহাগা। তাঁর কোন পুণ্য কাজই আল্লাহ প্রত্যাখ্যান করেন না, যদি নিষ্ঠার সাথে আদায় হয়। আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর যে ব্যক্তি মুমিন অবস্থায় কোন পুণ্য কাজ করে, তাঁর সে কাজের প্রত্যাখ্যান নেই’। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৯৪) অর্থাৎ, আল্লাহ্ তাঁর প্রতিটি পুণ্য আমলের প্রতিদান সংরক্ষিত রাখেন। সাধারণ মুমিনের প্রতিদান’র এ নিশ্চয়তা হলে সাহাবীর প্রতিদান’র তো কথাই নেই।
রাসূলে পাক (দ.)র প্রসিদ্ধ এক সাহাবীর নাম মুআয ইবনে জাবাল (রাদ্বি.)। তিনি ছিলেন খাযরাজ গোত্রীয় আনসারী। তাঁর উপনাম আবু আবাদিল্লাহ্। আঠারো বছর বয়সে ঈমান অনেন। বদরসহ পরবর্তী যুদ্ধসমূহে অংশগ্রহণ করেন। ইয়েমেনে কাযী নিযুক্ত হন। আটত্রিশ বছর বয়সে ওফাত পান। একবার তাঁর অনুরোধের প্রেক্ষিতে প্রিয়নবী হাদীয়ে মাহ্দী (দ.) তাঁকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নসীহত করেন। আজকের খুৎবা জুড়ে সেই প্রিয় বাণী সম্ভার, যা হেদায়তের মানসে পত্রস্থ হলো।
হযরত মুআয বিন জাবাল (রাদ্বি.) আরয করলেন, ‘আমাকে কিছু উপদেশ দিন’। তখন নবীজি ইরশাদ করলেন, ‘যদি তুমি কখনো অপছন্দনীয় কাজ করে ফেল, তখন সাথে সাথে প্রকাশ্যে ও গোপনে দু’টি ভাল কাজ করো’। এরপর পুনরায় আরয করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আরও কিছু উপদেশ’! ইরশাদ করলেন, ‘তুমি তোমার পুণ্যমান প্রতিবেশীকে যেমন লজ্জাবোধ করো, তেমন সমীহ বা হায়া আল্লাহ্কেও করো’। অতঃপর আরয করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্, আরো নসীহত খয়রাত করুন’। তখন তিনি ইরশাদ করলেন, ‘বিদায়ী ব্যক্তির মত নামায আদায় করো, যেন দুনিয়াতে এটাই তোমার শেষ নামায’। এরপর সাহাবী আবারো আরয করলেন, ‘আরো উপদেশ দিন, হে আল্লাহ্র রাসূল’। আল্লাহ্র রাসূল ইরশাদ করলেন, ‘তুমি অধিকহারে আল্লাহ্র যিক্র করো এবং কুরআন মাজীদ’র তেলাওয়াত করো। কেননা, এটা তোমার জন্য নূর (বা আলো হবে আসমানে, আর তোমার পথ চলায় আলো হবে এ পৃথিবীতে)। আর তুমি দেখো তার দিকে, যে তোমার চেয়ে নি¤œতরো অবস্থানে আছে। তার দিকে চেয়ো না, যে তোমার চেয়ে উচ্চস্তরে রয়েছে। (বস্তুতঃ নবীজির এ পরামর্শ জীবনের স্বস্তি ও আত্মতুষ্টির জন্য অতি সহায়ক)। আর তুমি নিঃস্ব, অভাবÑক্লিষ্ট মানুষদের ভালবেসো, আর তাদের সাথে উঠা বসা করো। (তাহলে উপলব্ধি করা যাবে, আল্লাহ্ তোমাকে কতটা ভাল রেখেছেন)। আর তুমি নিজ আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রেখো। কেননা, এটা তোমার জীবনÑজীবিকায় বরকত আনবে। (বাস্তবিকই, মনের স্বাচ্ছন্দ্য আর প্রিয়জনের সদ্ভাবই জীবনকে সুখের প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ করে। নিকটাত্মীয়দের সাক্ষাৎ, মেলাÑমেশা, ভালবাসায় মন প্রফুল্ল, সজীব হয়। তখন, অভাববোধ থাকে না। সহজ জীবনই বাঁচার প্রেরণা)।
এরপর আল্লাহ্র রাসূল তাঁর সাহাবী হযরত মুআয বিন জাবালকে আরো কয়টি অতি মূল্যবান উপদেশ দিয়েছেন। যেমন, তিনি (দ.) ইরশাদ করেন, ‘তুমি সত্য বল, সেটা তিক্ত হোক’। (আমরা শক্তিধরের রক্তচক্ষুর ভয়ে বা অবৈধ সুবিধা লাভের জন্যে সত্য বলতে কুণ্ঠিত হই। এতে পাপ হয়, কারণ মিথ্যা বলা যে রূপ পাপ, সত্য গোপন করা তেমনি পাপ। এতে বিধাতা ক্রোধান্বিত হন)। নবীজির ইরশাদ, ‘তুমি নিজ ক্রোধকে সম্বরণ করো। তোমার উচিত, তুমি তার সাথেও সদাচরণ করবে, যে তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। তুমি নিজের জন্য যেভাবে শুভ কামনা করো, তেমনি অপর ভায়ের জন্য ভালোটা প্রত্যাশা করো। জাগতিক মোহ থেকে নিজেকে দূরে রেখো’। (বস্তুতঃ মানুষকে সাধু হতে হলে সাধনা লাগে, শয়তানের অনুচর হতে সাধনার কী কাজ? আমরা নিজের সাথে বোঝাপড়া এভাবেই করে থাকি; কিন্তু অপরাধীর উদ্বেগÑউৎকণ্ঠা কি কম? একটি অপরাধ ঢাকতে আরো বহু অপরাধে জড়াতে হয়। ওষুধ সেবনেও যে সুনিদ্রা হয়না। কিন্তু আল্লাহ্র পথে চলতে এ ধ্বংসযজ্ঞের হাতছানি নেই। তাই এ অন্ধকার জগতে কেন, আলোর পথেই তো আনন্দ)। প্রিয়নবীর এ নসীহতটুকোই বদলে দিতে পারে আমাদের বিক্ষিপ্ত জীবনধারাকে।
জীবনযাত্রার পথে হোঁচট না খেতে মনে রাখার মত অনাগত প্রজন্মের জন্য প্রযোজ্য আরও কয়েকটি নীতিকথাও হেদায়তের নবী তাঁরা সাহাবীকে বলেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘ হে মুআয, পরিণামদর্শিতার মতো কোন প্রজ্ঞা নেই। চক্ষুলজ্জার ন্যায় কোন পরহেযগারী নেই। আদর্শ-চরিত্রের মত কোন আভিজাত্য নেই, আর জ্ঞান-প্রজ্ঞার মত নেই কোন কৌলিন্য।’। (কথাগুলোর অনেকটাই আবহমান কাল ধরে প্রবাদ বাক্যের মত আমাদের মুখে মুখে ফেরে। যেমন, আমাদের বহুলশ্রুত একটা কথা প্রচলিত, ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’। বস্তুতঃ নবীর বাণীর চেয়ে অমৃত মধুবাণী আর কোথা আছে! স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলাই ইরশাদ করেন, ‘যিনি আল্লাহ্র পথে মানুষকে ডাকেন, আর নেক কাজ সম্পাদন করেন এবং বলেন, নিঃসন্দেহে আমি আল্লাহর অনুগত, তাঁর চেয়ে সুন্দরতম বচনের আর কে আছে? ‘একথাটি যাঁর মুখে সবার আগেই শোভা পায়, তিনি আর কেউ নন, ‘খুলুকে আযীম’র মূর্ত প্রতীক, উসওয়ায়ে হাসানাহ্’র ধারক, সর্বোত্তম হেদায়তের মহানায়ক, রহমতে আলম, নূরে মুজাসসাম সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। নবীজির ইরশাদ, খাইরুল হাদ্য়ি হাদ্য়ূ মুহাম্মাদ। অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র হিদায়তই হলো সর্বোত্তম হিদায়ত।
বর্ণিত হাদীস শরীফ, যা মুআয বিন জাবাল (রাদ্বি.)’র আবেদনে মহানবী (দ.) ইরশাদ করেন, তাতে তেরোটি রয়েছে সরাসরি নির্দেশনা, চারটি মনে রাখার মত অতি প্রয়োজনীয় নীতি বাক্য। যেগুলো অনুসরণ করে চলতে পারলে মানবজীবনের সাফল্যে ফেরেশতাকুল ও ‘ধন্য, ধন্য’ করবেন। সংক্ষেপে বলা যায়, অন্তর্যামী প্রভুর প্রতি সর্বোচ্চ সমীহ, নিবিষ্টচিত্তে নামায আদায়, অধিকহারে যিকির, তেলাওয়াত, নি¤œমুখী দৃষ্টি, দুঃস্থজনের ভালবাসা, আত্মীয়তা সজীব রাখা, সত্যনিষ্ঠা, শত্রুর প্রতিও সদাচরণ, পার্থিব মোহত্যাগ, পরহিত ব্রত, ন¤্র আচরণ-জীবনে পরিস্ফুটন করাতে পারলে মুমিনের সফল জীবন।
লেখক : আরবী প্রভাষক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা। খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।