শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »
ঘরে চুলা জ্বলছে না। খাবার কিনতে হোটেল-রেস্তোরাঁয় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নগরের হালিশহর এলাকার বাসিন্দারা। আনুমানিক সকাল ১১টা থেকে গ্যাস না থাকার কথা জানান ওই এলাকার বাসিন্দা শমসের হোসেন। বাসায় রান্না না হওয়ায় অনেকে দুপুরের খাবার সেরেছেন রেস্টুরেন্টে, আবার কেউ চিড়া বা বন-পাউরুটি দিয়ে। তবে হোটেল- রেস্তোঁরায়ও দিনের বেশিরভাগ সময় চুলা না জ্বলায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার সরবরাহ করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতি ছিল নগরের অধিকাংশ এলাকায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) বিতরণ বিভাগের কাস্টমার মেইনটেন্যান্স শাখার ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুছ সুপ্রভাতকে বলেন, ‘মূলত এলএনজি সরবরাহ ঠিকভাবে না হওয়ায় আজ (শনিবার) গ্যাসের সংকট হয়েছে। জিটিসিএল (গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড) থেকে আমরা আজ সরবরাহ পেয়েছি ২৬০ মিলিয়ন ঘনফুট। অথচ আমাদের চাহিদা হলো ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এরমধ্যে কাফকো- সিইউএফএলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এরপরও ৩২০-৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট পেলে স্বাভাবিক রাখা যায়।’
জিটিসিএল সরবরাহ কম আসার কারণ জানতে চাইলে কাস্টমার মেইনটেন্যান্স শাখার ব্যবস্থাপক বলেন, ‘জিটিসিএল তো মূলত সাপ্লাইয়ার। আরপিজিসিএল (রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড) থেকে জিটিসিএল যতটুকু পায়, ততটুকু সরবরাহ করে। আরপিজিসিএলে সম্ভবত কোনো টেকনিক্যাল সমস্যা হয়েছে। তাই সাপ্লাই ঠিকভাবে হচ্ছে না।’
আরপিজিসিএল সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরে কাতারের রাস লাফফান লিকুইফিড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরএলএনজিসিএল) সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদে এবং ২০১৮ সালের ৬ মে ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের (ওটিআই) সঙ্গে ১০ বছর মেয়াদে চুক্তি হয়। এরমধ্যে কাতারের প্রতিষ্ঠানটি ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন (এমটিপিএ) এবং ওমানের প্রতিষ্ঠানটি ১ থেকে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিকটন (এমটিপিএ) এলএনজি প্রতিবছর সরবরাহ করে। চলতি বছরে আরএলএনজিসিএল ৩১টি এবং ওটিআই ১৩টি কার্গো সরবরাহ করে। এর বাইরে অনুমোদিত ২১টি প্রতিষ্ঠান থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সংগ্রহ করে আরপিজিসিএল।
গ্যাস সংকটের কারণ জানতে চাইলে আরপিজিসিএলের এলএনজি বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ কবির বলেন, ‘এখন মজুদের কিছুটা সংকট আছে। পরবর্তী শিডিউলের সঙ্গে ব্যালেন্স করে এখন কিছুটা কমিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই পিক আওয়ারে (সকাল ৯টা থেকে দুপুরে ২টা) কিছুদিন সংকট থাকবে। আমরা লং টার্মে যে কার্গোগুলো আনি সেগুলোর একটা নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। চাইলে চুক্তির বাইরে বেশি গ্যাস কার্গো আনা সম্ভব নয়। এজন্য আমরা স্পট মার্কেট থেকেও নিয়ে থাকি। তবে এবারের টেন্ডারে দাম বেশি হওয়ায় আমরা নিতে পারিনি। তাই রি-টেন্ডারের প্রক্রিয়া চলছে। আশা করি, স্পট মার্কেট থেকে কার্গো পেয়ে যাবো।
কার্গো পেলে গ্যাস সংকট থাকবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বছরে আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। এলএনজি টার্মিনালের মেইনটেন্যান্সের জন্য ড্রাইডকে নিতে হবে। পাঁচ বছর পর পর মেইনটেন্যান্সের কাজ করতে হয়। নতুবা কোনো কার্গো আর আমাদের টার্মিনালে ভিড়বে না। এবার প্রথমবারের মতো টার্মিনাল ড্রাই ডকে পাঠানো হবে নভেম্বরের মাঝামাঝি। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি মেইনটেন্যান্সের কাজ শেষে ফিরে আসবে। এ সময় পর্যন্ত কিছুটা ভোগান্তি থাকবে। আশা করছি ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে গ্যাসের আর সংকট থাকবে না।’
গ্যাস সংকটের প্রভাব দেশের প্রধানতম শিল্পখাতে কেমন পড়বে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক ও চিটাগং চেম্বারের পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ বলেন, ‘এখন পুরো বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতির কারণে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কেনাকাটা কেউ করছে না। তাই আমাদের ক্রয়াদেশ অনেক কমে গেছে। বলা যায়, ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম ক্রয়াদেশ নিয়ে আমরা এখন ব্যবসা করছি। এরমধ্যে জ্বালানিখাতে কোনো সংকট হলে আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হবে। অবশ্য আমরা এখনও কোনো সংকট দেখছি না। যদি সেরকম কোনো পরিস্থিতি হয়, তাহলে সরকার যেন শিল্পখাতকে বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অন্যথায়, শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যার প্রভাব পড়তে পারে দেশের বিনিয়োগ ব্যবস্থায়।’
প্রসঙ্গত, একসময় কুমিল্লার বাখরাবাদ, ফেনী বা সিলেট অঞ্চলের গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিড হয়ে কেজিডিসিএলে গ্যাস সরবরাহ করা হতো। দেশের জ্বালানি ঘাটতি মেটাতে ২০১০ সালে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেড (ইইবিএল) কক্সবাজারের মহেশখালীতে ১ লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার ধারণ ক্ষমতার একটি ভাসমান টার্মিনাল স্থাপন করে। ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট থেকে শুরু হয় এলএনজি সরবরাহ। এরপর ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে দেশীয় সামিট এলএনজি টার্মিনাল কোম্পানি লিমিটেড (এসএলএনজি) সরবরাহ শুরু করে। এ পাঁচ বছরে কেজিডিসিএলকে পুরোপুরি এলএনজি নির্ভর করা হয়েছে। তথ্যানুযায়ী, ইইবিএল ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৪৫৪ দশমিক ৯৪ এমএমএসসিএফ এবং এসএলএনজি ৪ লাখ ৭০ হাজার ১৮৮ দশমিক ৯১ এমএমএসসিএফ গ্যাস সরবরাহ করে।