এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ :
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিস্ট গ্রুপের গবেষণা ও বিশ্লেষণ শাখা ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের নতুন র্যাংকিং প্রকাশ করেছে। এই তালিকার শেষ দিক থেকে চার নম্বর স্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। বিভিন্ন দেশের শহরের ওপর জরিপ চালিয়ে ১৪০টি শহরের র্যাংকিং প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। সেখানে ১৩৭ নম্বরে রয়েছে ঢাকা। গত বুধবার (৯ জুন) বসবাস যোগ্যতার দিক থেকে বিশ্বের ১৪০ শহরের এ তালিকাটি প্রকাশ করে ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। নতুন এই জরিপ অনুসারে ২০২১ সালে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড। দ্বিতীয় অবস্থানে জাপানের ওসাকা। তৃতীয় অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড।
তালিকায় একেবারে তলানিতে রয়েছে সিরিয়ার দামেস্ক। ১৪০টি শহরের তালিকায় শহরটির অবস্থান ১৪০তম। ১৩৯তম অবস্থানে রয়েছে নাইজেরিয়ার লাগোস। ১৩৮তম অবস্থানে পাপুয়া নিউ গিনির পোর্ট মোরেসবি। এ ছাড়া ১৩৬তম অবস্থানে আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, ১৩৫তম অবস্থানে লিবিয়ার ত্রিপোলি ও ১৩৪তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানের করাচি। সার্বিক ব্যবস্থা ও অবস্থা কতটা খারাপ হলে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্কের কাছাকাছি ঢাকার অবস্থান হয়।
উড়োজাহাজ থেকে যদি ঢাকা শহর দেখা হয়, তবে বিল্ডিং ছাড়া কিছু দেখা যাবে না। এটার মূল কারণটা হচ্ছে, অতিরিক্ত মানুষের চাপ। কাজের সন্ধানে মানুষ যেভাবে ঢাকামুখী হয়েছে, যে শহরটাতে ৩০-৪০ লাখ মানুষ থাকার কথা সেটাতে দুই-আড়াই কোটি লোক থাকে। তাহলে শহরটির চেহারাতো এ রকমই হবে। চট্টগ্রামেরও একই অবস্থা।
আন্তর্জাতিক অনেক জরিপে রাজধানী নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমরা দেখতে পাই, এখানে বসবাসের মতো অবস্থা নেই। তারপর হচ্ছে যানজটের মতো একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যাগুলো দূর করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাই। সরকার অনেকগুলো ফ্লাইওভার করেছে, ইউলুপ করা হয়েছে। কিছু কিছু ইউলুপ এখন জ্যামের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বোঝা যাচ্ছে এগুলো নির্মাণে যথাযথ পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর ক্ষেত্রেও যানজট বাস্তব সত্য।
কিন্তু প্রধান প্রধান নগরগুলো বাসযোগ্য করতে হলে শুধু বিল্ডিং করলে হবে না। বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে অবশ্যই নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দেওয়া প্লান বা নকশা অনুসারে। ভবনের পাশে খালি স্থান না রেখে ইচ্ছামতো ভবন করা যাবে না। বাসযোগ্য নগরী করার জন্য আমাদের আইন ও বিধি-বিধান আছে। এখন দেখতে হবে এগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না। যাঁরা বাড়ি বানান তাঁরা কিন্তু আইন জানেন। অনেকে জেনেও আইন মানেন না। আইন পালন না করলে ভালো হবে না।
মুক্ত বাতাস, ভালো রাস্তাঘাট, পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং সুপেয় পানি একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু নগরবাসী কি এসব মৌলিক সুবিধাগুলো পাচ্ছে? ব্যাপক অধিবাসীর নাগরিকের বসবাস বস্তিতে। তাদের জন্য আমরা টেকসই কিছু করতে পেরেছি? ভবিষ্যতে তাদের জন্য কী করতে চাই; সেটিরও কোনো ব্যাখ্যা নেই। বস্তিতে আগুন লাগলে দেখা যায়, পুরো বস্তিই পুড়ে যায়। বস্তি রক্ষা করা যায় না। এতে বস্তির সবার আশ্রয় হয় খোলা আকাশের নিচে। ফায়ার সার্ভিস কিছুই করতে পারে না। বস্তিতে মাদকের ব্যবসা হয়, অসামাজিক কার্যকলাপ হয় এসব অভিযোগ তুলে তাদের উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রাখা যাবে না। বস্তিবাসীদের জন্য আলাদা চিন্তা করতে হবে। তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হবে। বস্তিবাসীর উন্নয়ন না করলে আমাদের নগরগুলো বাসযোগ্য হবে না। দেশে এরই মধ্যে যেসব বড় বড় শহর হয়ে গেছে, সেসব শহর নিয়ে পরিকল্পনা নেওয়া কঠিন। তবে নতুন করে যেসব শহর হতে যাচ্ছে, সেগুলো নিয়ে যে মহাপরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে, তা বাস্তবমুখী কিনা যাচাই করতে হবে, বাস্তবমুখী হলে তার যথাযথ বাস্তবায়ন হতে হবে।
নগরবাসীর দুটি অন্যতম ভোগান্তি রয়েছে। একটা হচ্ছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে নগরবাসীর ভোগান্তি। আরেকটা হচ্ছে একটু বৃষ্টিতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর ডুবে যাওয়া। আমাদের দেশে বর্ষাকালে রাস্তা খুঁড়ে কাজ করার বিষয়ে সব সময় পত্রপত্রিকা সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। কিন্তু ঘুরে-ফিরে সেই বর্ষাতেই খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি করলে রাস্তা পরিষ্কার করা যায় না। এর কারণে রাস্তায় জমে থাকা বালি বৃষ্টির পানির সাথে ড্রেনে পড়ে ড্রেনের পানি যাওয়ার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। ওয়াসার অভ্যন্তরীণ ড্রেনেজ কাঠামো আছে তারপরও পানি যাচ্ছে না। কোথায় যাবে পানিটা? যাবে খালে। কিন্তু খালই তো নেই। ঢাকা শহরে কাগজে-কলমে ৪৩টি খাল আছে। যার মধ্যে উত্তরায় আছে ২৫টা। এগুলো থেকে এখন লাইফ সাপোর্টে ১২-১৩টা খাল আছে। বাকিগুলো হারিয়ে গেছে। খালগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে। চট্টগ্রাম শহরের ৩৬টি খাল পুনরুদ্ধার করে গভীর করতে হবে।
নগরীর রাস্তা যদি নিরাপদ না হয় তাহলে সেটি কখনোই বাসযোগ্য হবে না। রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে পথচারীরা সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার স্বীকার হচ্ছে। নিরাপদ নগরী করতে হলে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। মহানগরগুলোকে নারীবান্ধব শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নারীদের জন্য আলাদা বাস সার্ভিস ঢাকায় চালু করা হয়েছে। নারীদের নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবন্ধীবান্ধব নগর ও রাত্রিকালীন আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
নাগরিকের জন্য গণপরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অথচ অর্থনীতির প্রাণখ্যাত এ পরিবহন খাতটি স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো গুরুত্বই পায়নি। আমাদের এখানে যখন কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, সেটি শেষ করতে পারে না। কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) করা হয়েছিলো, কিন্তু সেই দিকনির্দেশ অনুযায়ী কাজ হয়নি।
আমাদের পরিবহন খাতের তথ্যের অভাব নেই, প্রকল্পেরও অভাব নেই। অথচ ৭৬ শতাংশ নাগরিক গণপরিবহন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছে। ৮৮ শতাংশ দুর্ভোগের শিকার, ৯২ শতাংশ যাত্রীর অভিযোগ অতিরিক্ত ভাড়া, ৯০ শতাংশ যাত্রী জানে না কোথায় অভিযোগ দিতে হয়। সারা বিশ্বেই ফুটপাতকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা করা হয়। আর আমাদের এখানে ফুটপাত সব দখলে।
নগরে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে। রাস্তার পাশেও বড় বড় গাছ থাকতে হবে। কেউ কেউ রাস্তার পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেঙে পড়ার কথা বলেন। সেটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে পারে। তারপরও গাছ লাগাতে হবে।
যানজট, জলাবদ্ধতা চট্টগ্রাম মহানগরীর অন্যতম প্রধান সমস্যা। চট্টগ্রাম ক্রমবর্ধমান নগরী। সরকারের বেশ কিছু মেগা প্রজেক্ট বৃহত্তর চট্টগ্রামে হচ্ছে। অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি তথা দেশের প্রধান বাণিজ্যিক নগরী অথচ নগরীর অধিকাংশ ওয়ার্ডে উন্নয়নের ছোঁয়া নেই। অনেকটা মফস্বলীয় ধরনের। পরিকল্পিত নগরায়ণের সুযোগ রয়েছে এখানে। প্রাকৃতিক পরিবেশ বিচারে চট্টগ্রাম মহানগর সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। উন্নয়ন ও নগরায়ণ পরিকল্পনায় প্রকৃতি, পরিবেশের সৌন্দর্য অক্ষুন্নœ রাখা চাই।
দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ায় দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে। উন্নয়নের এই ছোঁয়া কম-বেশি লেগেছে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে। নগরায়ণের ক্ষেত্রে ঢাকাকে নিয়ে কিছুটা পরিকল্পনা থাকলেও অন্য সব এলাকায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। রাজধানীতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য হিসেবে এখনো গড়ে ওঠেনি ঢাকা। আধুনিক নগরায়ণের জন্য প্রয়োজন আরো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন।
লেখক : প্রাবন্ধিক