নিজস্ব প্রতিবেদক »
প্রতিবছর শীতকালে নানা পিঠা তৈরির ধুম লেগে যায় চট্টগ্রামে। বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে ফুটপাতের ভ্রাম্যমাণ দোকানে জমে পিঠা বিক্রি। সেই সুবাদে বাড়ে গুড়ের চাহিদা। এটিকে কাজে লাগিয়ে ‘খেজুর গুড়ের’ নামে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো নকল গুড় বাজারে বেশি মিলছে।
জানা যায়, বাজারে বিক্রি হওয়া খেজুরের গুড়ে তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে না প্রকৃত খেজুরের রস। আর আখের গুড় তৈরিতেও নেই আখের রস। তার বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে ঝোলা গুড়, দূষিত চিনির শিরা, হাইড্রোজ, নিষিদ্ধ খাবারের রং, স্যাকারিন, ফিটকিরি ও চুনসহ ক্ষতিকর নানা রাসায়নিক উপাদান। ইতিপূর্বে প্রশাসনের একাধিক অভিযানে ভেজাল গুড় তৈরির বিষয়টি ধরা পড়ে।
মঙ্গলবার নগরীর খাতুনগঞ্জ রোডের আছদগঞ্জের মুখ, রেয়াজউদ্দিন বাজার, টেরিবাজার, স্টেশন রোডের ফলমণ্ডি, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ কর্ণফুলী মার্কেটসহ বিভিন্নস্থানে ঘুরে দেখা যায়, পিঠাপুলি ও পায়েস বানাতে গুড়ের দোকানে ভিড় বেড়েছে মানুষের। বেড়েছে বেচাকেনাও।
বাজারে প্রতিকেজি ‘খেজুরের রস’ দিয়ে তৈরি তরল গুড় বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আর ঝোলা গুড় ও মালাই তৈরি খেজুর গুড় বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। বড় সাইজের খেজুর গুড় ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা, ছোট সাইজের গুড় ২২০ ও বাটালি গুড় ১৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে মাটির হাড়ি বা কলস কিংবা ময়লাযুক্ত প্লাস্টিকের ড্রামে গুড় বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা ও তরল গুড় বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়। অঞ্চলভেদে এসব গুড়ের দামেরও পার্থক্য রয়েছে।
বাজার সয়লাব এসব গুড়ের মান নিয়ে সংশয়ে আছেন বাজারে আসা ক্রেতারাও।
পিঠা বানানোর জন্য বকসিরহাট বাজারে গুড় কিনতে আসা ফারিয়া রায়হান বলেন, ‘পিঠার জন্য গুড় কিনতে আসলাম। কিন্তু বুঝতে পারছি না যে সত্যিই খেজুর গুড় নামে গুড়গুলো আসল নাকি নকল। বাজারে খেজুরের রসের চেয়ে গুড় সরবরাহ বেশি।
রেয়াজউদ্দিন বাজার ফলমন্ডিতে মো. আসাদুর রহমান নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের বাজারে এক কেজি খেজুরের রস বিক্রি করছে ১২০ টাকা। এককেজি তরল খেজুরের গুড় বানাতে হলে আগুনে ফুটাতে হবে ৭ থেকে ৮ কেজি রস। তাহলে সেই হিসেবে এক কেজি খেজুরের তরল গুড় হওয়ার কথা অনেক টাকা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। গুড় ব্যবসায়ীরা আসলেই খেজুরের গুড়ের নামে আমাদের কি খাওয়াচ্ছে?। প্রশাসনের বিষয়টি তদারকি করা প্রয়োজন।’
সরেজমিনে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে এসব গুড় আনা হয় রাজশাহী, নাটোর, বাগেরহাট, নওগাঁ, পার্বত্য এলাকা রাঙামাটি, বান্দরবান থেকে। তবে এসব গুড়ের প্রকৃত মান নিয়ে সংশয়ে আছেন খোদ ব্যবসায়ীরাও। তারাও কোনভাবে নিশ্চিত করতে পারছে না, এসব গুড় আসলেই খেজুর কিংবা আখের রসের তৈরি নাকি অন্য ক্ষতিকর উপাদান মেশানো। রেয়াজউদ্দিন বাজারের গুড় ব্যবসায়ী মো. ফারুক বলেন, ‘আমরা যেসব গুড় বিক্রি করছি তা কুষ্টিয়া ও যশোরের বিভিন্নস্থান থেকে কেনা। তবে এসব গুড় প্রকৃত খেজুরের রস দিয়ে বানানো কি’না আমরা জানি না।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টি গবেষকরা বলছেন, বাজারে বিক্রি হওয়া ভেজাল গুড় খাওয়ার ফলে মারাত্বক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (বারটান) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকতা ও আঞ্চলিক প্রধান ড. মো. নূর আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘গুড়ে যদি ভেজাল থাকে তাহলে তা স্বাস্থের জন্য বেশ ক্ষতিকর। এ বিষয়ে প্রশাসনের তদারকি জরুরি।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বী বলেন, ‘আসল খেজুর গুড় স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু বাজারে এখন ভেজালের ছড়াছড়ি। অনেকসময় দেখি ভেজাল গুড় বিভিন্ন রঙ ও কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি করা হয়। এগুলো খেলে কিডনি ড্যামেজ, খাদ্যনালিতে ক্যান্সার, আমাশয় ও লিভার ড্যামেজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই মানুষকে এসব খাবার এড়িয়ে যেতে হবে।’
বাজারে বিক্রি হওয়া ভেজাল খেজুরের গুড় নিয়ে তদারকি করবেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপদ কর্তৃপক্ষ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপদ কর্তৃপক্ষের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনের নিরাপদ খাদ্য অফিসার মোহাম্মদ বশির আহম্মেদ বলেন, ‘বাজারে ভেজাল গুড়ের বিষয়ে আমরা অবগত আছি। তাছাড়া খবর নিয়েছি যে চট্টগ্রামে এসব গুড় উৎপাদন হয় না। তবে ভেজাল গুড় উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করতে মাঠ পর্যায়ে আমরা কাজ করছি। এর ফলাফল আপনারা পাবেন।’
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘চট্টগ্রামে খেজুরের গুড় উৎপাদন হয় না। যেসব জেলায় এসব গুড় উৎপাদন হয়, সেখানে নজরদারি রয়েছে। তবুও বাজারে আসা গুড়গুলোর বিষয়টি তদন্তের ব্যাপারে আমি দপ্তরকে অবগত করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সিদ্ধান্ত নেব।’
এ মুহূর্তের সংবাদ