ধর্ষণের পর খুন করে লাশ নালায় ফেলে ‘খুনি’

সুপ্রভাত ডেস্ক »

নগরীতে নিখোঁজের তিনদিন পর সাত বছর বয়সী মেয়ের লাশ উদ্ধারের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। মেয়েটির বাসার অদূরের এক দোকান কর্মচারী তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে গুমের চেষ্টায় লাশ নালায় ফেলে দেয়। পুলিশ লক্ষণ দাশ নামে ওই যুবককে গ্রেফতার করেছে। খবর সারাবাংলার।

পুলিশ জানায়, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ২৪ অক্টোবর বিকেল থেকে প্রচ- ঝড়ো হাওয়ার কারণে পুরো এলাকা জনমানবহীন হয়ে পড়ার সুযোগ নিয়ে শিশুটিকে পাশবিক নির্যাতনের পর খুন করে লক্ষণ। রাতে শিশুটিকে খোঁজার জন্য তার অভিভাবকরা ওই দোকানে গেলে ‘নির্বিকার’ লক্ষণ তাদের পরামর্শ দেয় থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করার জন্য। তিনদিন পর যখন নালা থেকে শিশুটির বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হচ্ছিল, তখন উৎসুক জনতার সঙ্গে সেও ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। এমনকি শিশুটির মৃত্যুর জন্য পরিচিতদের কাছে আফসোসও করেছিল।

বৃহস্পতিবার রাত দেড়টায় নগরীর কোতোয়ালী থানার জামালখান এলাকায় ‘গোপাল মুহুরীর গলি’ হিসেবে পরিচিত ব্রিজ গলির প্রবেশমুখে শ্যামল স্টোর নামে ওই মুদির দোকান থেকে লক্ষণকে গ্রেফতার করা হয়েছে। লক্ষণ (৩০) লোহাগাড়া উপজেলার উত্তর পদুয়া গ্রামের ফেলোরাম দাশের ছেলে। মুদি দোকানের পেছনে গুদামে সে থাকতো বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের উপ কমিশনার (দক্ষিণ) মোস্তাফিজুর রহমান।

এর আগে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নগরীর কোতোয়ালী থানার জামালখান এলাকায় ব্রিজ গলির বড় নালা থেকে মৃত মারজানা হক বর্ষা (৭) নামে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। সে নগরীর কুসুমকুমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। তার বাবা আব্দুল হক মারা গেছেন। মা ঝর্ণা বেগম ও সৎ বাবা মোহাম্মদ ইউছুপের সঙ্গে জামালখান সিকদার হোটেলের পেছনে ব্রিজ গলির বাসায় থাকতো। তার আরও দুই বোন আছে।

লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ সন্দেহবশত শ্যামল স্টোরের ব্যবস্থাপক নিউটন দাশ সুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেয়। তবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে তেমন কোনো তথ্য মেলেনি বলে জানান উপ পুলিশ কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান।

যেভাবে রহস্য উন্মোচনের সূত্র মেলে
লাশ উদ্ধারের পর বস্তাটি পরীক্ষা করে পুলিশ দেখতে পায়, উপরে সাদা এবং ভেতরে ‘টিসিবির সিল’। সেই সিলকে সূত্র ধরেই পুলিশ এগোতে থাকে। আশপাশের এলাকার সব ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়।

নগর পুলিশের কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাস্থলের আশপাশের সকল মুদির দোকান, রেস্তোঁরার গুদামে এবং প্রতিষ্ঠানে পণ্যের বস্তা আমরা পরীক্ষা করতে শুরু করি। প্রায় ১৫টি প্রতিষ্ঠানের বস্তা পরীক্ষার পর শ্যামল স্টোরের গুদামে ঢুকে দেখা যায়- উপরে সাদা এবং ভেতরে টিসিবির সিলযুক্ত একটি বস্তা। আমরা লাশ উদ্ধার করেছি যে বস্তা থেকে সেটিও একইভাবে ছিল। তখন আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাই যে, শ্যামল স্টোরের কেউ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কারণ লাশটিও পাওয়া গেছে শ্যামল স্টোরের পেছনে একেবারে গুদাম সংলগ্ন নালায়।’

সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায় লক্ষণকে
ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে সংগ্রহ করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পুলিশ দেখতে পায়, ২৪ অক্টোবর বিকেল ৪টা ৩৯ মিনিটে গুদামের প্রবেশপথ দিয়ে শিশু বর্ষা দৌড়ে বের হয়ে আসছে। মিনিটখানেক পর ‘কেউ একজন’ ভেতর থেকে তাকে ডেকেছে এবং সে আবারও গুদামের ভেতরে প্রবেশ করেছে। আরেকটি ফুটেজে শিশুটিকে ডেকে গুদামের ভেতরে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটি লক্ষণ দাশ হিসেবে শনাক্ত হয়।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (দক্ষিণ) নোবেল চাকমা বলেন, ‘বিকেল সাড়ে ৪টায় বর্ষা তার বাসার গলি থেকে বের হয়ে জামালখানের মূল রাস্তায় আসে। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে গিয়ে সিকদার হোটেলের পাশের একটি দোকান থেকে চিপস কিনে। সেটি খেতে খেতে সে কিছুক্ষণ সমবয়সী কয়েকজনের সঙ্গে খেলাধুলা করে। এরপর ফুটেজে দেখা যায়, বর্ষা শ্যামল স্টোরের গুদামের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। জামালখানে মূল সড়কের পাশে ব্রিজ গলির প্রবেশমুখে শ্যামল স্টোর নামে দোকানটি। এর পেছনেই গুদামঘর। ব্রিজ গলির মধ্যে গুদামের পেছনদিকে আরেকটি প্রবেশপথ আছে।’

‘৪টা ৪০ মিনিটের পর বর্ষা আবার গুদামের ভেতরে ঢোকে। সেখানে তাকে ডেকে নেয়া লক্ষণের চেহারা আমরা শনাক্ত করি। ঘটনার সঙ্গে লক্ষণের জড়িত থাকার বিষয় যখন আমরা নিশ্চিত হই, তখন সে দোকানেই ছিল। আমরা তাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করি।’

নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ ফেলে দেয় নালায়
সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেলেও রাতভর জিজ্ঞাসাবাদে লক্ষণ দাশ ঘটনার সঙ্গে তার জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি। শুক্রবার ভোরে এডিসি নোবেল চাকমা, এসি মুজাহিদুল ইসলাম এবং ওসি জাহিদুল কবীর তাকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। টানা জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে লক্ষণ স্বীকার করে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেয়।

জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবীর জানান, ২৪ অক্টোবর বিকেলে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ঝড়ো হাওয়া, বৃষ্টি হচ্ছিল। জামালখান এলাকা প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। ব্রিজ গলিও ছিল জনমানবহীন। লক্ষণের সঙ্গে বর্ষার আগে থেকে কথাবার্তা হতো। মাঝে মাঝে বর্ষাকে চিপস-টকলেট দিত লক্ষণ।

‘বর্ষা যখন বাসা থেকে বের হয় তখন অবশ্য বৃষ্টি তেমন ছিল না। গুদামের পেছনের প্রবেশমুখে বর্ষাকে দেখে সে ডেকে ভেতরে নেয়। মিনিটখানেক পর বর্ষা বেরিয়ে আসে। এরপর লক্ষণ ১০০ টাকার একটি নোট বের করে বর্ষাকে ডাকলে সে ভেতরে যায়। ভেতরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষণ গুদামের দরোজা বন্ধ করে দেয়। সেখানে লক্ষণের ঘুমানোর একটি খাট আছে। সেই খাটে ফেলে শিশুটিকে ধর্ষণ করে। শিশুটি চিৎকার করেছিল, কিন্তু ঝড়ো হাওয়ার কারণে শব্দ বাইরে আসেনি। ধষর্ণের একপর্যায়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ দেখে লক্ষণ ভয় পেয়ে যায়। তখন শিশুটি চিৎকার করে কান্না করতে থাকলে সে গলা ও মুখ চেপে ধরে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শিশুটি নিস্তেজ হয়ে যায় এবং লক্ষণ বুঝতে পারে সে মারা গেছে।’- বলেন ওসি জাহিদুল কবীর।

জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এডিসি নোবেল চাকমা বলেন, ‘মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে গুদামে থাকা টিসিবির চিনির একটি খালি বস্তাকে উল্টিয়ে সেটার ভেতরে লাশ ঢোকায়। বস্তা উল্টানোর ফলে টিসিবির সিলটা ভেতরে চলে যায়। বস্তায় ভরে লাশ ফেলে দেয় গুদামের সঙ্গে লাগোয়া বড় নালায়। লাশ ফেলার পর দেখতে পায়, শিশুটির পোশাকগুলো রয়ে গেছে। সেগুলো পেঁয়াজের খোসাভর্তি আরেকটি বস্তার মধ্যে ভরে নালায় ফেলে দেয়। এরপর দেখে বর্ষার স্যান্ডেল রয়ে গেছে। সেগুলোও ফেলে দেয় নালায়। তখন ঝড়বৃষ্টির কারণে রাস্তায় মানুষজন কম থাকায় এবং সন্ধ্যার দিকে অন্ধকার হয়ে আসায় বিষয়টি কেউ দেখতে পায়নি। চতুর লক্ষণ সিসি ক্যামেরা এড়াতে গুদামের পেছনে অন্ধকারে লাশটি ফেলে দেয় নালায়।’

বস্তাভর্তি লাশ উদ্ধার হলেও পোশাক এবং স্যান্ডেলগুলো নালার পানিতে ভেসে যাওয়ায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পরপর কয়েকদিন যদি ভারি বৃষ্টি হতো, তখন বস্তাবন্দি লাশটি ভেসে নদীতে চলে যেত। তখন এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা কঠিন হয়ে যেত।’

ঘটনার পর ‘নির্বিকার’ লক্ষণ
ঘটনার রহস্য উন্মোচনে যুক্ত কোতোয়ালী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মৃণাল মজুমদার জানান, লাশ, পোশাক ও স্যান্ডেল ফেলে দেওয়ার ৫-৭ মিনিটের মধ্যেই লক্ষণ আবার দোকানে যায়। এরপর গুদাম থেকে চাল ও মুড়ির বস্তা নিয়ে যায় দোকানে। এরপর তিনদিন স্বাভাবিকভাবেই সে দোকানে কাজ করেছে।

‘ঘটনার রাতে বর্ষার মা-বোনেরা যখন তাকে খুঁজছিল, শ্যামল স্টোর থেকে বের হয়ে লক্ষণ তাদের সঙ্গে কথা বলে। বর্ষা নিখোঁজ শুনে সে তাদের পরামর্শ দেয় থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করার জন্য। বর্ষার পরিবারের সদস্যরা প্রথমে স্থানীয় কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের কাছে যান। কাউন্সিলর তাদের থানায় পাঠান। বর্ষার বোন ছালেহা আক্তার রুবি থানায় জিডি করেন।’- বলেন এসআই মৃণাল।

এসআই মোমিনুল হাসান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ট্রিপল নাইনে ফোন পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। লাশ উদ্ধারের সময় সেখানে উৎসুক জনতার ভিড় জমে যায়। হত্যাকা-ে জড়িত হিসেবে যখন শনাক্ত করি লক্ষণকে, তখন আরেক ফুটেজে দেখা যায় উৎসুক জনতার মধ্যে সে-ও ছিল। এমনকি স্থানীয় হিসেবে আশপাশের পরিচিতদের কাছে বর্ষার মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য আফসোসও করতে দেখা গেছে তাকে। তবে বাইরে যতই স্বাভাবিক আচরণ করুক, মনের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে, তিনদিন ধরে সে ভাত খেতে পারেনি, ঘুমাতে পারেনি।’

জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন জানিয়েছেন, লাশ উদ্ধারের পর থেকে শ্যামল স্টোর বন্ধ আছে। দোকানটির মূল মালিক কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। এখন আরেকজন দোকানটি ভাড়ায় নিয়ে পরিচালনা করছেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রাজীব নামে এক ব্যক্তি বর্তমানে দোকানটির মালিক। তবে তিনি দোকানে বসেন না। নিউটন দাশ সুজন ব্যবস্থাপক হিসেবে দোকানটি পরিচালনা করেন।

শিশুটিকে খুনের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত আছে কি না সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এসি-কোতোয়ালী মুজাহিদুল ইসলাম।
এদিকে বর্ষাকে হারিয়ে তার মা-বোনদের কান্না আর থামছে না। লক্ষণকে গ্রেফতারের খবর পেয়ে নগরীর মোমিন রোডে সিএমপির দক্ষিণ জোনের উপ পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে ছুটে যান তারা। বর্ষার মা ঝর্ণা বেগম বিলাপ করতে করতে বলতে থাকেন, ‘আমার আদরের ধনকে আমার বুকে এনে দেন। আমার মেয়েকে যে এত কষ্ট দিয়ে মেরেছে আমি তার বিচার চাই। আমি তার ফাঁসি চাই।’

মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে ঝর্ণা বেগম বাদি হয়ে কোতোয়ালী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।