চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র (সিএইচআরসি) আয়োজনে গতকাল সকাল ৯ টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে ‘বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ ও চর্যাপদের উৎসভূমি চট্টগ্রাম’ বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের উপদেষ্টা লেখক লায়ন দুলাল কান্তি বড়–য়ার সভাপতিত্বে ও সিএইচআরসির সভাপতি সোহেল মো. ফখরুদ-দীনের পরিচালনায় সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। সেমিনারের উদ্বোধন করেন অধ্যাপক প্রকৌশলী মৃনাল কান্তি বড়ুয়া।
সেমিনারে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিএম আকরাম হোসেন, অধ্যাপক ড. জ্ঞানশ্রী বড়–য়া, অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ রায়, ইতিহাসবিদ সিএইচআরসির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইউনুস কুতুবী, অধ্যাপক ড. রিটন বড়–য়া, অধ্যক্ষ ড. শেখ এ রাজ্জাক রাজু, ড. সবুজ বড়–য়া শুভ, কবি মাহমুদুল হাসান নিজামী, কবি বিশ্বজিৎ বড়–য়া, কবি সাংবাদিক আবু সালেহ, প্রাবন্ধিক নেছার আহমদ খান, ডায়ম- সিমেন্ট লি.’র ডিজিএম মোহাম্মদ আবদুর রহিম, সুমন বড়–য়া ভোপেল, কবি নাজমুল হক শামীম, সাফাত বিন সানাউল্লাহ, সাংবাদিক সুমন বড়–য়া, সৈয়দ খোন্দকার ফছিহুল হক, কবি দেলোয়ার হোসেন মানিক, সংগঠক চৌধুরী জসিমুল হক, সংগীতশিল্পী সমীর পাল প্রমুখ।
সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম পদ সংকলন তথা বাংলা সাহিত্যের প্রধান নিদর্শন। ভারতীয় আর্য ভাষারও প্রাচীনতর রচনা এটি। খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এটি প্রাচীন চট্টগ্রামে লিখিত হয়। এর রচিয়তা অনেকের বাড়ি চট্টগ্রাম। রচিত এ গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় অর্থ সাংকেতিক রূপের আশ্রয়ে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তাঁরা পদগুলো রচনা করেছিলেন। সেমিনারে বিজ্ঞ বক্তারা আরো বলেছেন, উনিশ শতকের শুরুর দিকেও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ছিল প্রায় পুরোটাই অন্ধকারে। ১৮৮২ সালে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের গ্রন্থে সর্বপ্রথম নেপালে বৌদ্ধতান্ত্রিক সাহিত্যের কথা উল্লেখ করেন। এর পরই এ নিয়ে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়।
১৯০৭ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক প-িত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ দরবারের গ্রন্থাগার থেকে ‘সরহপাদের দোহাকোষ’, ‘কৃষ্ণপাদের দোহাকোষ’, ‘ডাকার্ণব’, এবং ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ নামে চারটি প্রাচীন গ্রন্থ আবিষ্কার করেন। এর পরই সূচিত হয় বাংলা সাহিত্যের নতুন এক প্রাচীন অধ্যায়।
এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বাংলা ভাষার প্রাচীন ইতিহাসের কথা। ১৯১৬ সালে গ্রন্থগুলো একত্রে করে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে সম্পাদকীয় ভূমিকাসহ ‘হাজার বছরের পুরাতন বাংলা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়। ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’-এর নাম দেন চর্যাপদ। অন্য তিনটি গ্রন্থের ভাষা অপভ্রংশ হলেও চর্যাপদ ছিল প্রাচীন বাংলায় রচিত। প্রকাশের পর এর ভাষা নিয়ে বিভিন্ন মতপার্থক্য দেখা দিলেও ভাষাবিদ ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থে এর ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেন যে এর ভাষা মূলত প্রাচীন বাংলা। তবে সেই সময়ের সেন রাজাদের কট্টরপন্থি মনোভাবের জন্য পদকর্তারা বাংলা ভাষার একধরনের বিশেষ রূপ ব্যবহার করেন, যা অনেকেই ‘আলো আঁধারি ভাষা’ বা ‘সান্ধ্য ভাষা’ নামে অভিহিত করে থাকেন। এর রচনার সময়কাল নিয়েও মতভেদ রয়েছে।
সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর পক্ষে মত দিয়েছেন অনেকে ইতিহাসবিদ। চর্যাপদটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মীয়গুরুদের সাধন সংগীত। এর প্রতিটি কাব্যকে আলাদাভাবে পদ বলা হয়। আর কবিদের বলা হয় পদকর্তা। পদকর্তারা ‘সিদ্ধাচার্য’ নামেও পরিচিত ছিলেন। মোট ২৪ জন পদকর্তার পদ ছিল ৫১টি। এর মধ্যে ৪৬টি পূর্ণাঙ্গ ও একটির আংশিক খ- উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। পদকর্তাদের মধ্যে সর্বাধিক ১৩টি পদ রচনা করেন কাহ্নপা, দ্বিতীয় সর্বাধিক আটটি পদ রচনা করেন ভুসুকুপা। এ ছাড়া লুইপা, কুক্কুরীপা, ডোম্বীপা প্রমুখ ছিলেন এর অন্যতম কবি। কবিদের অনেকেই পূর্ব ভারত ও নেপাল রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের, কেউ পূর্ববাংলার চট্টগ্রামে, কেউ উত্তর বাংলার অধিবাসী ছিলেন বলে ধারণা করেন।
বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আমীন চর্যাপদের শ্লোকের ভাষাকে চট্টগ্রামে আঞ্চলিক ভাষার সাথে মিল খুঁজে পেয়েছেন। তিনি তাই প্রাচীন এই পুঁথির কবিগণের আবাসভূমি চট্টগ্রামে বলে উল্লেখ করেছেন। তবে বেশির ভাগই ছিলেন বাঙালি ছিলেন। চর্যার পদগুলো সহজিয়ামার্গীয় কবিদের ধর্মীয় সাধনগীতি হলেও এর মধ্যে বাঙালি জাতির প্রাচীন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, ইতিহাস, স্থান, পাহাড়, পর্বত ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের বর্ণনা করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি