আলী প্রয়াস »
কোরিয়ান ঔপন্যাসিক হান কাং এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এটি তার অসাধারণ সাহিত্যকর্মের প্রতি একটি বড় সম্মান; সেসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, কারণ তার লেখা বিশ্বব্যাপী পাঠকদের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর ‘দ্যা ভেজিটারিয়ান’ ‘দ্যা হোয়াইট বুক’-সহ অন্যান্য কাজ মানুষের মনস্তত্ত্ব, সমাজ এবং মানব-প্রকৃতির জটিলতার ওপর গভীর আলোচনার সৃষ্টি করেছে। তার সাহিত্য শুধুমাত্র কোরিয়ান সাহিত্যের জন্য নয়, বরং বিশ্ব সাহিত্যকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। এই পুরস্কারের মাধ্যমে হান কাংয়ের বিশ্বব্যাপী সাহিত্যিক অবদান আরও গৌরবময় হয়ে উঠল এবং এটি তার জনপ্রিয়তা এবং প্রভাব আরও বাড়িয়ে দেবে। আরও প্রশংসা ও সম্মান এনে দেবে।
সম্প্রতি হানের ‘দ্যা ভেজিটারিয়ান’ উপন্যাসটি পড়ে তা নিয়ে কিছু লেখা ইচ্ছে তৈরি হলো। এটি তাঁর একটি সেলিব্রেটেড উপন্যাস, যা ২০০৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং বিশ্বজুড়ে সাহিত্যিক আলোচনা অর্জন করেছে। এই উপন্যাসটি দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে এক ব্যক্তির ভেজিটেরিয়ান হওয়ার পেছনের গল্পকে কেন্দ্র করে, তবে এর মূল বিষয়টি আরও গভীর, রহস্যময় এবং মানুষের মনস্তত্ত্বের অন্ধকার দিকগুলোকে অনুসন্ধান করে।
কাহিনির সারাংশ
‘দ্যা ভেজিটারিয়ান’-এর প্রধান চরিত্র ‘ইয়ং হিউ’ একজন সাধারণ কোরিয়ান গৃহিণী। কাহিনির শুরুতেই, ইয়ং হিউ এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেন-তিনি মাংস খাওয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেন। এই সিদ্ধান্তটি শুধু তার পরিবারকে হতবাক করে না, বরং তার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার ওপরও একটি গভীর প্রভাব ফেলে। ইয়ং হিউর এই ভেজিটেরিয়ান হওয়া যেন এক সংকেত, যা তার অজানা অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের সূচনা।
কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত সহজভাবে গ্রহণ করা হয় না। ইয়ং হিউর পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে তার স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু একসময় তার আচরণ আরও অদ্ভুত হয়ে ওঠে, তিনি সম্পূর্ণ ভিজুয়াল এবং আধ্যাত্মিক মাত্রায় পরিণত হন, যা গল্পটিকে আরও রহস্যময় এবং বিমূর্ত করে তোলে। ইয়ং হিউর এই পরিবর্তন তার চারপাশের মানুষের জীবনকে বিঘ্নিত করে, তাদের মানসিক অবস্থার ওপর এক অপ্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টি করে।
উপন্যাসের মূল বিষয় এবং বিশ্লেষণ
‘দ্যা ভেজিটারিয়ান’ একাধিক স্তরে মানুষের মনস্তত্ত্ব, বোধশক্তি, এবং যৌনতা নিয়ে আলোচনা করে। এটি শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন নিয়ে নয়, বরং আরও গভীর আধ্যাত্মিক পরিবর্তন এবং আত্মপরিচয়ের সংকট নিয়ে আলোচনা করে। যেমন- শরীর এবং আত্মা। ইয়ং হিউর ভেজিটেরিয়ান হওয়া শুধু এক খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন নয়, এটি তার আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানও। শরীর এবং আত্মার সম্পর্কের এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত হয় এই উপন্যাসে। তিনি যখন মাংস খাওয়া ছেড়ে দেন, তখন তার শরীরের চেয়েও তার মনোজগতের পরিবর্তন ঘটতে থাকে বেশি।
ঔপন্যাসিকের লেখায় এক ধরনের গভীর মানসিক অস্থিরতা দেখা যায়। তার চরিত্রেরা প্রায়শই তাদের নিজস্ব শরীর, মন এবং সমাজের প্রতি এক ধরনের প্রত্যাখ্যান বা বিভ্রান্তির মধ্যে আটকে পড়ে। ‘দ্যা ভেজিটেরিয়ান’-এ, ইয়ং হিউনিজের শরীরের প্রতি এক ধরনের বিরক্তি এবং ঘৃণা অনুভব করতে থাকে, যা তার আহারের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। সমাজ থেকে মেনে নেওয়া এবং প্রথাগত আচরণগুলির বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ একটি মৌলিক থিম, যা হান কানের কাজের একটি প্রধান স্তম্ভ।
আলোচ্য উপন্যাসের একটি অন্যতম প্রধান থিম হলো ‘শরীর’ এবং তার প্রতি চরিত্রগুলোর প্রতিবাদ বা অস্বীকৃতি। ‘দ্যা ভেজিটেরিয়ান’ বইটি বিশেষভাবে শরীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একটি রূপক। ইয়ং হিউ তার শরীরের সাথে সম্পর্কের অবসান ঘটানোর জন্য গাছের মতো নিরামিষাশী হয়ে উঠতে চায়, যাতে তার শরীরের অধিকার তার নিজের হাতে থাকে। এটি শরীরের স্বাধীনতা, সমাজের শারীরিক এবং মানসিক নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে একটি প্রশ্ন।
একাকীত্ব এবং সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক
হানের উপন্যাসে একাকীত্ব একটি অন্যতম বিষয়। তার চরিত্রেরা প্রায়ই তাদের জীবনকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অবিচ্ছিন্নভাবে একাকী বোধ করে। ইয়ং হিউর পরিবারের সদস্যরা তার অস্বাভাবিক আচরণকে বুঝতে পারে না এবং একে কঠোরভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। বিশেষত ‘দ্যা ভেজিটেরিয়ান’-এ ইয়ং হিউর চরিত্রটি তার একাকীত্ব এবং স্বীকৃতির অভাব অনুভব করে, যার ফলে সে তার শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটা এমন এক সমাজের প্রতিফলন যেখানে মানুষের চাহিদা, আকাক্সক্ষা, এবং অভ্যন্তরীণ পৃথিবী প্রায়শই অগ্রাহ্য হয়।
ভেজিটেরিয়ান-এর সাহিত্য শৈলী
হানের লেখার শৈলী খুবই সুতীক্ষè এবং বিমূর্ত। তার ভাষা সরল হলেও গভীর, এবং তার লেখায় অনেক জটিলতা এবং সূক্ষ্মতা রয়েছে। ‘দ্যা ভেজিটারিয়ান’ একটি তীব্র আবেগ এবং শারীরিক বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে, যা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে এবং মানব মনস্তত্ত্বের নানা দিক তুলে ধরে। এ উপন্যাসের সাহিত্য শৈলী হান কাংয়ের এক বিশেষ সৃষ্টিশীলতার পরিচয়। এই উপন্যাসটি তার লেখনিতে অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব, বিমূর্ততা এবং মনস্তাত্ত্বিক গভীরতার একটি শৈল্পিক মিশ্রণ তৈরি করেছে। তিনি তার লেখার মাধ্যমে পাঠককে এক এক ধরনের জটিলতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যান, যা ভাষা, দৃষ্টিকোণ এবং গঠনশৈলীর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চলুন, দেখি কীভাবে তাঁর সাহিত্য শৈলী এই উপন্যাসে বিশেষত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
বিমূর্ততা এবং রহস্যময়তা
হান কাং একটি ‘বিমূর্ত শৈলী’ ব্যবহার করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি ইয়ং হিউ-এর আচরণের মানে এবং তার মানসিক অবস্থার গভীরতা বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। তার খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন শুধু শারীরিক পরিবর্তন নয়, বরং এটি তার মানসিক এবং আধ্যাত্মিক পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। গল্পটি কখনও সরাসরি ব্যাখ্যা করে না, বরং বিভিন্ন আঙ্গিকে এবং ইঙ্গিতের মাধ্যমে পাঠককে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।
ইয়ং হিউর চরিত্রের ভিতরের অন্ধকার, তার অনমনীয় মনোভাব এবং তার আচরণের গভীর অর্থ পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা না হওয়ার কারণে, উপন্যাসটির প্রতি পাঠকের আগ্রহ অব্যাহত থাকে। এই অপ্রকাশিত রহস্য এবং মনের অস্থিরতা এক ধরনের শক্তিশালী আবেগ সৃষ্টি করে।
আলংকারিক ও গভীর ভাষা
হান কাং তাঁর ভাষায় বিশেষত আলংকারিক উপমা ও মেটাফোর ব্যবহার করেছেন, যা উপন্যাসটির আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক স্তরের মধ্যে যোগসূত্র ¯’াপন করে। ইয়ং-হিউ-এর ভেজিটেরিয়ান হওয়া একটি মেটাফোর, যা শারীরিক রূপান্তরের পাশাপাশি একটি আধ্যাত্মিক ও মানসিক রূপান্তরকেও বোঝায়। খাবারের প্রতি তার অনাগ্রহ, সহিংসতা থেকে তার দূরে সরে যাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত নির্জনতার দিকে এগিয়ে যাওয়া একটি রূপক হিসেবে কাজ করে।উপন্যাসের ভাষা কাব্যিক এবং মৃদু, তবে একই সঙ্গে তীক্ষè এবং অনুভূতিপূর্ণ। হান কাং শব্দের প্রতি গভীর মনোযোগ দেন, প্রতিটি বাক্য যেন একটি আবেগ, মনস্তাত্ত্বিক অব¯’ান, কিংবা মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে।
সংকট
কথাসাহিত্যিক হান কাংয়ের ‘দ্যা ভেজিটারিয়ান’ একটি শৈল্পিক, বিমূর্ত এবং মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস, যা তার সাহিত্যের গভীরতা এবং বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য প্রশংসিত হয়েছে। চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, ভাষার শিল্পশৈলী এবং সংকটের প্রতি সজাগ দৃষ্টি এই উপন্যাসটিকে একটি অতুলনীয় সাহিত্যকীর্তি বানিয়েছে। তিনি এ বছর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। এটি তাঁর লেখনি এবং সাহিত্যিক দক্ষতার একটি বড় স্বীকৃতি। যিনি তাঁর গভীর, সূক্ষ্ম এবং কাব্যিক লেখার জন্য পরিচিত। এর আগে ২০১৬ সালে ‘ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার’ জিতেছিলেন। তাঁর রচনারাজি মানবমনের অন্ধকার দিক এবং একাকীত্বের অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করে। বিশেষত, তাঁর সাহিত্য আধুনিক সমাজের মানসিক চাপ, শোষণ এবং সুশৃঙ্খল অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের চিত্র তুলে ধরে। হান কাংয়ের সৃষ্টিকর্মগুলো আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম উপহার।