সুপ্রভাত ডেস্ক »
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ হওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশের। আর এই লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে সব ধরনের রপ্তানি পণ্যে প্রণোদনা হ্রাসে সরকারের নেওয়া কৌশলগত সিদ্ধান্তে অন্যান্য অনেক রপ্তানি খাতের মতো দেশের চামড়া খাতও ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছে।
দেশের চামড়া খাতের রপ্তানিকারকরা বলছেন, লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডাব্লিউজি) সনদ না থাকা, কমপ্লায়েন্স ও পরিবেশসহ নানা ইস্যুতে এমনিতেই বিপর্যস্ত দেশের চামড়া শিল্প। এ অবস্থায় পূর্বঘোষণা ছাড়াই ক্রাস্ট লেদার রপ্তানিতে রপ্তানি প্রণোদনা ১০ শতাংশ থেকে শূন্যে নামিয়ে আনার ঘোষণায় ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কা করছেন তারা। খবর টিবিএস।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা ছাড়াই ক্রাস্ট লেদারে রপ্তানি প্রণোদনা ১০ শতাংশ থেকে শূন্যে নামিয়ে আনার এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী ছাড়া আর কিছুই নয়। বিষয়টি নিয়ে তারা ইতোমধ্যে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর সাথে আলাপ করেছেন। পাশাপাশি ক্ষতি এড়াতে প্রধানমন্ত্রীরও হস্তক্ষেপ চান তারা।
ইউরোপের বাজারে প্রবেশাধিকার না থাকায় কোনো রকমে চীন নির্ভর হয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন এই খাতের রপ্তানিকারকরা।
এর আগে গত মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সার্কুলারে জানায়, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী সময়ে একত্রে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না করে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকেই সরকার বিভিন্ন ধাপে নগদ সহায়তা/প্রণোদনার হার অল্প অল্প করে হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকেই হ্রাসকৃত প্রণোদনা হার কার্যকর হয়েছে, যা আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
ঘোষণা অনুযায়ী ক্রাস্ট লেদার রপ্তানিতে রপ্তানি প্রণোদনা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য শতাংশ করা হয়েছে। যদিও ফিনিশড লেদারে এটি ১০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ কমিয়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘দেশের চামড়া শিল্পের মোট রপ্তানির ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই ক্রাস্ট লেদার। মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ রপ্তানি হয় ফিনিশড লেদার। কাজেই ক্রাস্ট লেদারের ওপর থেকে রপ্তানি প্রণোদনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত এ খাতকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এছাড়াও অনেকের লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডাব্লিউজি) সনদ নেই, যা ইউরোপে ভাল ব্র্যান্ডের সাথে ব্যবসা করার জন্য প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘পরিবেশ-কমপ্লায়েন্স ইস্যু ও এলডাব্লিউজি সনদ ছাড়া এই খাতের ব্যবসায়ীদের তাদের ব্যবসা সচল রাখতে কেবল চীনের বাজারই ভরসা। এই পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতার বাজারে চীন নির্ভর হয়ে যেখানে বর্তমানে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে পূর্বঘোষণা ছাড়াই রপ্তানি প্রণোদনা হ্রাসের এই সিদ্ধান্তে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়তে হবে ব্যবসায়ীদের।’
তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ চামড়াই কোরবানির সময় মজুদ করে ট্যানারিগুলো। চামড়া খাতের রপ্তানির ট্যানারিগুলোতে গত কোরবানির মৌসুমে মজুদকৃত চামড়ার একটি বড় অংশ এখনো অবিক্রিত রয়ে গেছে।’
প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে সব ট্যানারিই ব্যাবসায়ীক কৌশলের অংশ হিসেবে সরকার ঘোষিত রপ্তানি প্রণোদনার হিসাবকে মাথায় রেখে চামড়া ক্রয় থেকে শুরু করে বায়ারদের থেকে ক্রয়াদেশ নিয়ে থাকে। কাজেই হঠাৎ করে নেওয়া এই সিদ্ধান্তে ট্যানারিগুলোর সম্ভাব্য লোকসান ঠেকানোর কোনো পথ আর খোলা থাকছে না।
রপ্তানি প্রণোদনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা তার একটি উদাহরণ তুলে ধরেন সাভারের বিসিক চামড়া শিল্প নগরীর আরকে লেদারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমীন।
তিনি বলেন, ‘গত কোরবানির মৌসুমে সব মিলিয়ে দুই লাখ পিস কাঁচা চামড়া আমার কারখানায় মজুদ করা হয়েছে, যার ৭৫ শতাংশ চামড়া এখনো অবিক্রিত। এরপর আরও অন্তত ৫০ হাজার চামড়া পরবর্তী সময়ে তার ট্যানারিতে সংগ্রহ করা হয়েছে, যার সবটাই ক্রয় করা হয়েছে ক্রাস্ট লেদারের ১০ শতাংশ রপ্তানি প্রণোদনাকে মাথায় রেখে। বায়ারদের থেকে ক্রয়াদেশগুলোও সেই হিসাবে নেওয়া রয়েছে তার।’
নুরুল আমীন বলেন, ‘এখন যদি এই ১০ শতাংশ প্রণোদনা প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে শুধু মজুদকৃত চামড়াতেই আমার নিশ্চিত লোকসান তিন থেকে চার কোটি টাকা।’
তিনি মজুদকৃত চামড়া বিক্রির জন্য ক্রাস্ট লেদারের ওপর রপ্তানি প্রণোদনা প্রত্যাহার করার আগে এক বছরের ট্রানজিশন পিরিয়ডের পরামর্শ দেন। চামড়া শিল্পে তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বিপজ্জনক বলে সতর্ক করেন তিনি।
সামিনা ট্যানারির সিইও মোখলেছুর রহমান রিপন বলেন, ‘গত কোরবানির মৌসুমে আমরা প্রায় এক লাখ পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছি, স্কয়ার ফিটে যা ২৬ থেকে ২৮ লাখ স্কয়ার ফিট। এর পুরোটাই আমরা ক্যাশ ইনসেনটিভকে মাথায় রেখে কেনা।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতি মাসে গড়ে ৫.৮০ লাখ স্কয়ার ফিট চামড়া রপ্তানি হয়, গড়ে ১.৬ মার্কিন ডলার রেট ধরলেও এর মূল্য দাঁড়ায় ৯.২৮ লাখ ডলার। অর্থাৎ ১০ শতাংশ রপ্তানি প্রণোদনা প্রত্যাহারে অর্থ এখানে আমার প্রতি মাসে এখন ৯২.৮ হাজার ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হবো।’
স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা ছাড়াই হুট করে নেওয়া এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘আমার মনে হয় না এই খাতের উন্নয়নে কারো আন্তরিকতা আছে।’