দুর্গোৎসব ঘিরে সর্বোচ্চ সতর্কতা : ৩৩ হাজার মণ্ডপে নজিরবিহীন নিরাপত্তা

সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার একটি পূজামণ্ডপে প্রতিমা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে সোনালি আঁশ পাট

সুপ্রভাত ডেস্ক »

আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর (রোববার) ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। প্রতিবছরের মতো এবারও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পূজাকে ঘিরে ব্যাপক উচ্ছ্বাস ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

সারা দেশের পূজামণ্ডপগুলোতে চলছে শেষ মুহূর্তের কর্মযজ্ঞ। প্রতিমা তৈরি, মণ্ডপ সাজসজ্জা ও বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে সর্বত্র এখন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। তবে, উৎসবের এই আনন্দ যাতে নির্বিঘ্নে এবং নিরাপদে উদযাপিত হয়, সেজন্য দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সর্বোচ্চ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে প্রায় ৩৩ হাজার পূজামণ্ডপে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকবে। প্রতিটি পূজামণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর (বুধবার) থেকে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠে নামবেন। তবে এর আগেই নিরাপত্তা কার্যক্রম ও গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু হয়েছে মাঠপর্যায়ে। বিভিন্ন বাহিনী এরইমধ্যে গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করেছে। রাজধানীতে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ফোর্স মোতায়েন শুরু করেছে এবং প্রতিটি থানার আওতায় পূজামণ্ডপগুলোতে টহল কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) তাদের ১৫টি ব্যাটালিয়নকে পূজা উপলক্ষ্যে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে এবং গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করেছে।

dhakapost

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, দুর্গাপূজা ঘিরে সরাসরি নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হওয়ার মতো কোনো আশঙ্কা বা গোয়েন্দা তথ্য এখনো নেই সরকারের কাছে। পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন স্বাভাবিক থাকে সেজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য অনেক আগেই বাহিনীগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। আসন্ন দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা ঝুঁকি বা কোনো ধরনের আশঙ্কা না থাকলেও সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটতে পারে, সেসব বিষয় বিবেচনা রেখেই প্রতিটি বাহিনী তাদের নিজস্ব সক্ষমতা অনুযায়ী নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করেছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর দুর্গাপূজা ঘিরে সরাসরি কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি বা হুমকির তথ্য সরকারের কাছে নেই। তবে এ ধরনের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার ঝুঁকি থেকে যায়। তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখার পাশাপাশি সাইবার মনিটরিং কার্যক্রমও জোরদার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছু পক্ষ পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করতে পারে। এ কারণেই নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ধরনের ফাঁকফোকর রাখা হচ্ছে না।

দুর্গাপূজার নিরাপত্তা নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে, পূজামণ্ডপগুলো যেন কোনোভাবেই অরক্ষিত না থাকে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মণ্ডপের ভেতর ও আশপাশে থাকবে পুলিশের সার্বক্ষণিক টহল টিম। পাশাপাশি সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা গোপনে দায়িত্ব পালন করবেন।

dhakapost

এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস. এন. মো. নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ডিএমপি এরইমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে থানাগুলো থেকে। থানার টিম প্রতিদিন পূজামণ্ডপে গিয়ে নিরাপত্তার খোঁজখবর নিচ্ছে এবং কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করছে। পূজার দিন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হবে।

র‌্যাবও পূজার নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা নিয়েছে। প্রায় নয় হাজার র‌্যাব সদস্য সারাদেশের পূজামণ্ডপগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করবেন বলে জানা গেছে। সে লক্ষ্যে টহল টিম, সাইবার মনিটরিং, ডগ স্কোয়াড এবং বোম ডিসপোজাল ইউনিট সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবে, যাতে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

এ বিষয়ে র‌্যাব লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে র‌্যাব এরইমধ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে। দেশের সব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে র‌্যাব কাজ করছে। প্রতিটি ব্যাটালিয়নের এলাকায় কতগুলো মণ্ডপ রয়েছে এবং কোথায় ঝুঁকি থাকতে পারে সেসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে, যাতে প্রয়োজনে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

দুর্গাপূজা-কে কেন্দ্র করে র‍্যাবের সাইবার মনিটরিং ২৪ ঘণ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কেন্দ্র করে যেন কোনো ধরনের গুজব না ছড়িয়ে পড়তে পারে সেজন্য র‍্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া র‍্যাবের ডগ স্কোয়াড ও বোম ডিসপোজাল ইউনিট প্রস্তুত রয়েছে।

dhakapost

র‍্যাব বাহিনীর যে নয় হাজার সদস্য তাদের এখন অন্যতম মূল লক্ষ্য দুর্গাপূজা সুষ্ঠুভাবে এবং নিরাপদে সম্পন্ন হয়, বলেন তিনি।

এবারও সর্বাধিক সদস্য মোতায়েন করছে আনসার ও ভিডিপি। প্রায় দুই লাখ আনসার সদস্য দেশজুড়ে পূজামণ্ডপগুলোতে দায়িত্ব পালন করবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী মণ্ডপগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে— অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণ। প্রতিটি মণ্ডপে আনসারের টহল টিম দায়িত্ব পালন করবে, আর ভিডিপি থাকবে সার্বক্ষণিকভাবে।

এ বিষয়ে আনসার ও ভিডিপির গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. আশিকউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুর্গাপূজা-কে কেন্দ্র করে আনসার বাহিনীর ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আনসার সদস্যরা কাজ করে যাবেন। প্রতিটি মণ্ডপে আনসারের টহল থাকবে। এছাড়া ভিডিপি সার্বক্ষণিক পূজামণ্ডপে পূজা চলাকালীন সময়ে দায়িত্বে থাকবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের সব পূজামণ্ডপকে তিন ভাগে ভাগ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে আনসার। এই তিন ভাগে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রায় দুই লাখেরও বেশি আনসার সদস্য সারাদেশে মোতায়েন থাকবে।

এছাড়া স্বেচ্ছাসেবকদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে এবারের দুর্গাপূজায়। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা পুলিশ, র‌্যাব ও আনসারের পাশাপাশি নিরাপত্তায় সহযোগিতা করবেন। তিনি আরও বলেন, এবারের দুর্গাপূজায় কোনো ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর আরও সুসংগঠিতভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রতিমা ভাঙার ঘটনা অনেক কমেছে, আর যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে শনাক্ত করা হচ্ছে।